ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার: বিস্তারিত গাইডলাইন
ডেঙ্গু জ্বর একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিশেষত বাচ্চা এবং বয়স্কদের জন্য এটি হতে পারে প্রাণঘাতী। ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়া এখন অত্যন্ত জরুরি।
ডেঙ্গু জ্বর কী এবং কেন হয়?
ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ যা প্রধানত এডিস মশার কামড়ে হয়। স্ত্রী এডিস মশা ভাইরাসের বাহক হিসেবে কাজ করে। যখন ভাইরাস আক্রান্ত কোনো মশা কাউকে কামড়ায়, তখন এটি তার রক্তে প্রবেশ করে এবং ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ প্রকাশ পায়। ডেঙ্গু সাধারণত চারটি ভিন্ন ধরনের ভাইরাস দ্বারা হতে পারে। যারা আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলো ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার তিন থেকে পনেরো দিনের মধ্যে প্রকাশ পায়। সাধারণত, ডেঙ্গু জ্বরের প্রধান লক্ষণগুলো হলো:
উচ্চ মাত্রার জ্বর (১০২ থেকে ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট)।
মাথাব্যথা।
চোখের পেছনে ব্যথা।
শরীর এবং গাঁটে ব্যথা।
বমি ও বমি বমি ভাব।
চামড়ায় লালচে র্যাশ।
ক্ষুধা কমে যাওয়া।
পেশি দুর্বলতা ও শীতলতা অনুভব করা।
অনেক সময় এসব উপসর্গ ছাড়াও ডেঙ্গু হতে পারে। বিশেষত বাচ্চাদের ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ হতে পারে অস্বাভাবিক। তারা অস্বাভাবিক দুর্বলতা বা খিটখিটে মেজাজ প্রদর্শন করতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরের পরিবর্তিত লক্ষণ
বর্তমানে ডেঙ্গু জ্বরের কিছু নতুন এবং পরিবর্তিত লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এগুলোকে কমপ্লিকেটেড ডেঙ্গু সিনড্রোম বা এক্সটেনডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম বলা হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়া: তিন থেকে চার দিন ধরে ডায়রিয়া চলতে থাকলে দেরি না করে ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো উচিত।
জ্বর না থাকা: অনেকেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেও তাদের জ্বর থাকে না। শুধুমাত্র অন্য উপসর্গ থেকে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়।
স্থায়ী বমি: বমি শুরু হলে তা সহজে থামে না।
মস্তিষ্কে প্রদাহ: প্রচণ্ড মাথাব্যথা, ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া বা খিঁচুনি হতে পারে।
হাত-পা ফুলে যাওয়া।
পেটে পানি জমা: বিশেষত বুকে ও পেটে পানি জমলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
অসহ্য পেট ব্যথা।
ডেঙ্গু জ্বরের ধরণ
ডেঙ্গু জ্বর দুই ধরনের হতে পারে:
ক্ল্যাসিকাল ডেঙ্গু জ্বর: সাধারণত দুই থেকে সাত দিনের মধ্যে এটি ভালো হয়ে যায়।
হেমোরেজিক ডেঙ্গু জ্বর: এটি বেশি বিপজ্জনক। এই ক্ষেত্রে রোগীর রক্তক্ষরণ, প্লাটিলেট কমে যাওয়া এবং মাল্টি-অরগান ফেইলিউর হতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরের সময়কাল
ডেঙ্গু সাধারণত জুন থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত বেশি দেখা যায়। তবে বর্তমানে ডেঙ্গুর সময়কাল আরো বাড়ছে। গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে এর প্রকোপ বেশি।
বাচ্চাদের ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ
বাচ্চাদের ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ প্রায়ই বড়দের তুলনায় ভিন্ন হতে পারে। তাদের মধ্যে দেখা যেতে পারে:
বারবার কান্না বা খিটখিটে মেজাজ।
খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া।
বমি বা ডায়রিয়া।
শ্বাসকষ্ট বা দ্রুত শ্বাস নেওয়া।
শরীরের তাপমাত্রা বেশি বেড়ে যাওয়া।
ডেঙ্গু প্রতিরোধের উপায়
ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য সচেতনতা সবচেয়ে জরুরি। এডিস মশার বংশবৃদ্ধি এবং কামড় থেকে নিজেকে বাঁচাতে:
পানি জমতে না দেওয়া: বাড়ি বা অফিসের আশেপাশে কোথাও তিন দিনের বেশি পানি জমতে দেবেন না।
লম্বা পোশাক পরা: শরীর ঢেকে রাখার জন্য দিনের বেলায় লম্বা হাতার পোশাক পরুন।
মশারি ও স্প্রে ব্যবহার করা।
ফুলের টব, এসি বা ফ্রিজ পরিষ্কার রাখা।
দিনের বেলায় ঘুমানোর সময় সতর্ক থাকা।
ডেঙ্গু জ্বরে করণীয়
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে:
বিশ্রাম নিন: শারীরিক পরিশ্রম এড়িয়ে চলুন।
প্রচুর পরিমাণে পানি ও তরল পান করুন: ডাবের পানি, স্যালাইন ও ফলের রস উপকারী।
ডাক্তারের পরামর্শ নিন: জ্বর শুরু হওয়ার পাঁচ দিনের মধ্যে NS1 টেস্ট করানো উচিত।
প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ খাবেন না। অ্যাসপিরিন বা অন্যান্য ব্যথানাশক ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে ক্ষতিকর।
ডেঙ্গু রোগীর খাদ্যতালিকা
ডেঙ্গু রোগীর খাবার অবশ্যই পুষ্টিকর ও সহজপাচ্য হওয়া উচিত।
তরল খাবার: ডাবের পানি, স্যুপ, ফলের রস, দুধ।
প্রোটিন ও আয়রনসমৃদ্ধ খাবার: মাছ, ডিম, মুরগির মাংস।
পানি: প্রতিদিন আড়াই থেকে তিন লিটার পানি পান করুন।
কোন লক্ষণে দ্রুত হাসপাতালে যাবেন?
তীব্র পেটে ব্যথা।
প্রচণ্ড মাথাব্যথা বা মস্তিষ্কে প্রদাহ।
শরীরে লালচে ছোপ।
শ্বাসকষ্ট।
হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া।
প্রস্রাবে রক্তপাত।
ডেঙ্গু জ্বর কি ছোঁয়াচে?
ডেঙ্গু ছোঁয়াচে নয়। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এলে বা তার ব্যবহার করা জিনিস ব্যবহার করলে এটি ছড়ায় না। তবে রোগীর যত্ন নিতে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে।
উপসংহার
ডেঙ্গু জ্বরকে কখনোই সাধারণ জ্বর ভেবে অবহেলা করা উচিত নয়। ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরি। প্রাথমিক অবস্থায় ডেঙ্গু শনাক্ত করে সঠিক চিকিৎসা শুরু করলে বিপদ এড়ানো সম্ভব। তাই জ্বর বা অস্বাভাবিক কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। সচেতন থাকুন, সুস্থ থাকুন।