ফেরাউনের ইতিহাস ও তার শাস্তির দৃষ্টান্ত
ফেরাউন ইতিহাসের এমন একজন শাসক যার নামে আজও অত্যাচার ও খোদাদ্রোহের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। মিশরের প্রাচীন শাসক ফেরাউন কেবলমাত্র একজন নির্দয় শাসকই ছিলেন না, বরং নিজেকে খোদা দাবি করতেন এবং তার প্রজাদেরকে আল্লাহর পরিবর্তে তার ইবাদত করতে বাধ্য করতেন। কুরআনে ফেরাউনের বিভিন্ন অত্যাচারের বর্ণনা এবং তার চূড়ান্ত পরিণতির বিবরণ দেওয়া হয়েছে, যা থেকে সারা বিশ্বের মানুষের জন্য শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে।
ফেরাউনের সীমাহীন অত্যাচার
ফেরাউন ছিল এমন এক শাসক, যিনি নিজেকে এতটাই ক্ষমতাশালী মনে করতেন যে তিনি তার জনগণকে নিজের উপাসনা করতে বলেছিলেন। ফেরাউনের সীমালঙ্ঘন সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা মুসা (আ.)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন:
“(হে মুসা!) ফেরাউনের নিকট যাও, সে তো সীমালঙ্ঘন করেছে। তাকে বলো, 'তোমার কি আত্মশুদ্ধির কোনো আগ্রহ আছে? আমি কি তোমাকে তোমার প্রতিপালকের পথ দেখাব, ফলে তুমি তাঁকে ভয় করবে?’” (সুরা নাজিয়াত, আয়াত ১৭-১৯)
ফেরাউন আল্লাহর নিদর্শনগুলো দেখেও তা অস্বীকার করেছিল। সে আল্লাহর পথে চলার পরিবর্তে অহংকারের সাথে নিজের গৌরব ঘোষণা করে বলেছিল:
“আমিই তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিপালক।” (সুরা নাজিয়াত, আয়াত ২৪)
এমনকি ফেরাউন তার বিরুদ্ধে কোনো বিদ্রোহী মানসিকতার দেখা পেলে ভয় দেখিয়ে বলত:
“যদি আমাকে ছাড়া আর কাউকে ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করো, আমি তোমাকে কয়েদিদের অন্তর্ভুক্ত করব।” (সুরা শুআরা, আয়াত ২৯)
ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ফেরাউনের নির্মমতা
ফেরাউন তার শাসন এবং ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সমাজে বিভক্তি সৃষ্টি করে এবং জনগণকে নির্মমভাবে অত্যাচার করত। তিনি বিশেষ করে শিশুদের হত্যার মাধ্যমে তার ক্ষমতা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। কোরআনে ফেরাউনের এই নির্যাতন সম্পর্কে বলা হয়েছে:
“ফেরাউন তার দেশে প্রভাবশালী হয়ে পড়েছিল এবং সে দেশবাসীকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে তাদের একটি দলকে দুর্বল করে দিয়েছিল। সে তাদের পুত্রসন্তানদের হত্যা করত এবং নারীদের জীবিত রাখত। নিশ্চয়ই সে ছিল অনর্থ সৃষ্টিকারী।” (সুরা কাসাস, আয়াত ৪)
ফেরাউন শিশুদের হত্যা করত এই ভয়ে যে, ভবিষ্যতে কোনো শিশু বড় হয়ে তার শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে। তার নির্যাতন ছিল নির্মম এবং অমানবিক, যা সাধারণ জনগণকে আতঙ্কিত করে রাখত।
ফেরাউনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
“ফেরাউন” নামটি কোনো ব্যক্তির নাম নয়; এটি মিশরের শাসকদের একটি উপাধি। মিশরীয় সভ্যতার ইতিহাসে ফেরাউনেরা ছিল কিবতি বংশের শাসক, যারা কয়েক শতাব্দী ধরে মিশর শাসন করেছেন। মিশরের শাসকরা তাদের যুগে পিরামিড নির্মাণ, লাশ মমি করার মতো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও সাফল্যের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। এই শাসকগণ মিশরীয় সভ্যতার উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন এবং ইতিহাসে তাদের স্থাপন করা বিভিন্ন নিদর্শন আজও বিদ্যমান।
হজরত মুসা (আ.)-এর সময়ে, মিসরে দুটি উল্লেখযোগ্য ফেরাউন শাসন করেছিল। দ্বিতীয় রামাসিস ছিলেন অত্যাচারী ফেরাউন, যিনি মুসা (আ.)-এর সতর্কতা অগ্রাহ্য করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র মানেপতাহ ফেরাউনের পদে অধিষ্ঠিত হন এবং তিনিই সাগরে ডুবে মারা যান।
ফেরাউনের উজির হামান
ফেরাউনের শাসনামলে তার উজির হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন হামান, যিনি তাকে দুনিয়ার একমাত্র শক্তি হয়ে উঠার স্বপ্ন দেখাতে লাগলেন। হামানের পরামর্শ অনুযায়ী, ফেরাউন জনগণকে মূর্খ করে রাখার জন্য শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। স্কুল ও মক্তব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, যাতে কেউ লেখা-পড়া শিখতে না পারে এবং বিদ্রোহী হয়ে না ওঠে।
ফেরাউন তার উজির হামানের নির্দেশে প্রজাদের তার মূর্তি পূজায় বাধ্য করত, যাতে প্রজারা তাকে একমাত্র উপাস্য বলে মান্য করে। হামানের কুটিল পরামর্শের কারণে ফেরাউন পুরো মিশরে নিজের নামে একটি বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলে।
মুসা (আ.)-এর ফেরাউনের মুখোমুখি হওয়া
ফেরাউনের অত্যাচারের সময় আল্লাহ তায়ালা হজরত মুসা (আ.)-কে ওহী নাজিল করেন এবং তাকে ফেরাউনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে নির্দেশ দেন। আল্লাহর নির্দেশে মুসা (আ.) তার বড় ভাই হারুন (আ.)-কে সঙ্গে নিয়ে ফেরাউনের দরবারে উপস্থিত হন এবং তাকে সতর্ক করে দেন:
"তুমি যে নিজেকে খোদা বলে দাবি করছ, তা অত্যন্ত অন্যায়। সর্বশক্তিমান আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ উপাস্য নয়। আমি আল্লাহর প্রেরিত দূত।"
ফেরাউন মুসা (আ.)-এর বার্তাকে তুচ্ছ করে এবং তাকে এবং তার ধর্মের অনুসারীদের উপর নির্যাতন চালাতে থাকে। ফেরাউনের এই অত্যাচার ছিল মুসা (আ.)-এর বিরুদ্ধে তার দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন, যা দিন দিন আরো বাড়তে থাকে।
আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা লোকদের ওপর ফেরাউনের অত্যাচার
ফেরাউন তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে মুসা (আ.) এবং আল্লাহতে বিশ্বাসীদের উপর নির্মম নির্যাতন চালিয়েছিল। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে:
"ফেরাউন বলল, 'আমি তোমাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলব এবং তোমাদের সবাইকে শূলে চড়াব।’” (সুরা আরাফ, আয়াত ১২৪)
তার নীতি ছিল বিদ্রোহীদের নির্মূল করা, এবং আল্লাহর আদেশকে উপেক্ষা করা। ফেরাউনের এই অত্যাচার এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে মুসা (আ.)-কে আল্লাহ নির্দেশ দেন মিশর থেকে তার অনুসারীদের নিয়ে চলে যেতে।
মুসা (আ.)-এর নেতৃত্বে মুক্তির পথ ও ফেরাউনের ধাওয়া
মুসা (আ.) আল্লাহর আদেশে তার অনুসারীদের নিয়ে মিশর থেকে বের হয়ে লোহিত সাগরের দিকে যাত্রা করেন। ফেরাউন তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে তাদের ধাওয়া করে এবং তারা সাগরের তীরে পৌঁছে গেলে মুসা (আ.) আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী তার লাঠি দিয়ে সাগরের উপর আঘাত করেন। আল্লাহর কুদরতে সাগর দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় এবং মুসা (আ.) ও তার অনুসারীরা সেই পথে নিরাপদে সাগর পার হয়ে যান।
ফেরাউনের ধ্বংস এবং চূড়ান্ত পরিণতি
ফেরাউন তার বাহিনীসহ লোহিত সাগরে প্রবেশ করলে আল্লাহ মুসা (আ.)-কে আবারও তার লাঠি দিয়ে সাগরের ওপর আঘাত করতে বলেন। এর ফলে সাগরের দুই পাশে থাকা বিশাল পানির দেয়াল ফেরাউন ও তার সৈন্যদেরকে ডুবিয়ে মারে। ফেরাউন এবং তার পুরো বাহিনী সাগরের গভীরে তলিয়ে যায়।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন:
“ফেরাউন ও তার বাহিনী জমিনে অন্যায় অহংকার করেছিল। সুতরাং আমি তাকে ও তার সৈন্যদের পাকড়াও করলাম এবং সাগরে নিক্ষেপ করলাম।” (সুরা কাসাস, আয়াত ৩৯-৪০)
ফেরাউন মৃত্যুর সময় আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে চেয়েছিল, কিন্তু তখন আর তা গ্রহণ করা হয়নি। তার অহংকারের শাস্তি হিসেবে আল্লাহ তার দেহকে সংরক্ষণ করেছেন, যাতে পরবর্তী প্রজন্ম তার ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে পারে।
ফেরাউনের লাশের আবিষ্কার
ফেরাউনের লাশ আবিষ্কার করা হয় ১৯০৭ সালে। জনশ্রুতি আছে যে ফেরাউনের লাশ প্রথমে সিনাই উপদ্বীপের পশ্চিম তীরে আবিষ্কৃত হয়। এরপর ১৮৯৬ সালে থেবস নামক স্থানে একটি সমাধি থেকে আরও প্রমাণ পাওয়া যায়। মিশরের রাজধানী কায়রোর রয়্যাল মিউজিয়ামে ফেরাউনের মমি সংরক্ষিত আছে, যা আজও দেখার জন্য বিশ্বব্যাপী পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
বিশ্ববাসীর জন্য শিক্ষা
ফেরাউনের ঘটনাটি শুধুমাত্র ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে নয়, বরং সারাবিশ্বের মানুষের জন্য এক বিশাল শিক্ষা। আল্লাহর আদেশের বিরোধিতা এবং অহংকারের চূড়ান্ত ফলাফল কি হতে পারে, ফেরাউনের জীবন ও মৃত্যু তার প্রতীক।
আজকের মানুষ ফেরাউনের কাহিনি থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে। অত্যাচারী শাসকদের করুণ পরিণতি আমাদের দেখায় যে, কোনো শক্তি বা ক্ষমতা আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারবে না।
ফেরাউন কে কিভাবে মারা হয়েছিল?
কোরানে যে ফেরাউনের উল্লেখ, সেই ফেরাউন হলেন "মারনেপতাহর"। তাকেই পানিতে চুবিয়ে মারা হয়।
ফেরাউনকে সত্যের পথে আহ্বান করেন কে?
হজরত মুসা (আ.) ফেরাউন ও তার অনুসারীদের বহুদিন সত্যের দাওয়াত দেন। কিন্তু তারা তাঁর আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে নানা ধরনের অত্যাচার ও উত্পীড়নের পথ বেছে নেয়।
ফেরাউনের কতজন সন্তান ছিল?
প্রাচীন মিশরীয় ফারাও রামেসিস দ্বিতীয়ের প্রচুর সংখ্যক সন্তান ছিল: 48 থেকে 50 পুত্র এবং 40 থেকে 53 কন্যা - যাদের তিনি বিভিন্ন স্মৃতিস্তম্ভে চিত্রিত করেছিলেন।
ফেরাউনের স্ত্রীর নাম কি?
জান্নাতের মহিলাদের মধ্যে সর্বাধিক বিশিষ্ট হলেন খাদিজা বিনতে খোওয়ালাদ ও ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ, ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া বিনাত মুযাহিম ও মরিয়ম বিনতে ইমরান।
মিশরের শেষ ফেরাউন কে ছিলেন?
ক্লিওপেট্রা , মিশরের শেষ ফারাও, ইতিহাসের সবথেকে বিখ্যাত নারী শাসক হতে পারেন। কিন্তু তার রোমান শত্রুরা তাকে সব ভুল কারণে কুখ্যাত করে তুলেছিল: তার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, তার জমকালো জীবনধারা এবং সর্বোপরি জুলিয়াস সিজার এবং মার্ক অ্যান্টনির সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক।