বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ কোন দেশের তৈরি এবং এর খরচ ও মেয়াদকাল
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ বাংলাদেশের প্রথম ভূস্থির যোগাযোগ ও সম্প্রচার উপগ্রহ হিসেবে বাংলাদেশের প্রযুক্তি ও যোগাযোগ খাতে এক অনন্য অর্জন। ২০১৮ সালের ১১ মে এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ৫৭তম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাইলফলক স্পর্শ করে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এবং এটি স্পেসএক্সের ফ্যালকন ৯ ব্লক ৫ রকেটের প্রথম বাণিজ্যিক পণ্য উৎক্ষেপণ ছিল। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ এর মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত ক্ষমতার বিকাশ ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের নতুন দুয়ার উন্মোচিত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ কোন দেশের তৈরি?
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ কে ফ্রান্সের থ্যালাস অ্যালেনিয়া স্পেস কোম্পানি নকশা ও তৈরি করে। এটি স্পেসএক্সের ফ্যালকন ৯ রকেটের সাহায্যে মহাকাশে প্রেরণ করা হয়। স্যাটেলাইটটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে নামকরণ করা হয় এবং এটি বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি এবং সম্প্রচার খাতকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রকল্পের ইতিহাস
বাংলাদেশে মহাকাশ গবেষণা ও প্রযুক্তির বিকাশের ইতিহাস ২০০৮ সাল থেকে শুরু হয়। তখন বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন কৃত্রিম উপগ্রহ প্রকল্পের পরিকল্পনা করে। ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্পেস পার্টনারশিপ ইন্টারন্যাশনালকে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর ২০১৫ সালে বিটিআরসি রাশিয়ার ইন্টারস্পুটনিক কোম্পানির কাছ থেকে অরবিটাল স্লট কিনে নেয়।
২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের সার্বিক ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড গঠন করা হয় এবং প্রকল্পের জন্য ৫,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০১৮ সালে সফল উৎক্ষেপণের মাধ্যমে এই প্রকল্পের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের নির্মাণ ব্যয় ও অর্থায়ন
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ২৯৬৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয় প্রায় ১৩১৫ কোটি টাকা, যা মোট ব্যয়ের ৪৪ শতাংশ। অবশিষ্ট অর্থ সংগ্রহের জন্য বিডার্স ফাইন্যান্সিং এবং বিদেশি ঋণের মাধ্যমে অর্থায়ন করা হয়। উল্লেখযোগ্যভাবে, ২০১৬ সালে এইচএসবিসি ব্যাংকের সাথে ১৪০০ কোটি টাকার ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা ২০ কিস্তিতে ১২ বছরে পরিশোধ করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ এর বিবরণ ও ক্ষমতা
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ উপগ্রহটি ১১৯.১° পূর্ব দ্রাঘিমার ভূস্থির স্লটে স্থাপিত হয়েছে এবং এটি ১৬০০ মেগাহার্টজ ক্ষমতাসম্পন্ন মোট ৪০টি কে-ইউ এবং সি-ব্যান্ড ট্রান্সপন্ডার বহন করছে। স্যাটেলাইটটির আয়ুষ্কাল প্রাথমিকভাবে ১৫ বছর ধরা হলেও এটি ১৮ বছর পর্যন্ত কার্যকর থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট এর বাইরের অংশে বাংলাদেশের পতাকা এবং 'বঙ্গবন্ধু ১' লেখা রয়েছে, যা বাংলাদেশী প্রযুক্তির অন্যতম প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
উৎক্ষেপণ প্রক্রিয়া
২০১৮ সালের ১১ মে ফ্যালকন ৯ রকেটের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ উৎক্ষেপণ করা হয়। এটি ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। এর আগে বেশ কয়েকবার আবহাওয়া এবং কারিগরি সমস্যার কারণে উৎক্ষেপণ পিছিয়ে গিয়েছিল। অবশেষে, ১১ মে সাফল্যের সঙ্গে এটি মহাকাশে স্থাপন করা হয় এবং ১২ মে থেকে স্যাটেলাইটটি পরীক্ষামূলক সংকেত প্রেরণ শুরু করে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ব্যবহার ও সুবিধা
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ এর মাধ্যমে বাংলাদেশ অনেক সুবিধা অর্জন করেছে।
টিভি সম্প্রচার
বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সম্প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ট্রান্সপন্ডার ভাড়া নিয়ে চ্যানেলগুলো তাদের অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে, যার ফলে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে। তাছাড়া, দেশের টিভি চ্যানেলগুলোও বিদেশি স্যাটেলাইটের উপর নির্ভরশীল না থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ ব্যবহার করতে পারছে।
ইন্টারনেট সংযোগ
উপগ্রহটির ব্যান্ডউইথ ও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে, যেমন পার্বত্য এলাকা এবং হাওড় এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হয়েছে। এর ফলে উচ্চগতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সুবিধা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে।
দুর্যোগ মোকাবেলায় যোগাযোগ
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ বিশেষ করে বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যখন মোবাইল নেটওয়ার্ক বা টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে জরুরি যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রাখা সম্ভব হয়।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও মেয়াদকাল
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ এর কার্যকারিতা প্রাথমিকভাবে ১৫ বছর হলেও এর মেয়াদ ১৮ বছর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার সম্ভাবনা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন যে, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এটি দীর্ঘদিন কার্যকর রাখা সম্ভব হবে।
ভূকেন্দ্র ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটটি চালু হওয়ার পর গাজীপুর ও রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় স্থাপিত ভূকেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। জয়দেবপুরের ভূকেন্দ্রটি মূল নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে, আর বেতবুনিয়ার ভূকেন্দ্র ব্যাকআপ হিসেবে রাখা হয়েছে। এছাড়া, আন্তর্জাতিকভাবে স্যাটেলাইটের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের জন্য ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনে দুটি উপকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ব্যবহারকারী দেশসমূহ
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ব্যবহার বর্তমানে শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোও এর ট্রান্সপন্ডার ভাড়া নিয়ে সম্প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশগুলো হলো:
- হন্ডুরাস: ২টি বেসরকারি টিভি চ্যানেল
- তুরস্ক: ১টি বেসরকারি টিভি চ্যানেল
- ফিলিপাইন: ২টি টিভি চ্যানেল
- ঘানা: ৩টি টিভি চ্যানেল
- ক্যামেরুন: ১টি বেসরকারি টিভি চ্যানেল
- দক্ষিণ আফ্রিকা: ২টি অনলাইন ভিত্তিক টিভি চ্যানেল
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের সুযোগ-সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ এর অনেক সুবিধা রয়েছে, তবে কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে।
সুবিধাসমূহ:
- বৈদেশিক মুদ্রা আয়: স্যাটেলাইটের ট্রান্সপন্ডার ভাড়া দিয়ে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে।
- ডিটিএইচ সার্ভিস: ডিরেক্ট টু হোম (ডিটিএইচ) সার্ভিস চালু করার মাধ্যমে বাংলাদেশ সরাসরি স্যাটেলাইট থেকে টিভি চ্যানেল দেখার সুবিধা পাচ্ছে।
- উচ্চ গতির ইন্টারনেট: দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান সম্ভব হচ্ছে, যা দেশের ডিজিটালাইজেশনে বড় ভূমিকা রাখছে।
- দুর্যোগ মোকাবেলা: প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় এই স্যাটেলাইট জরুরি যোগাযোগ ব্যবস্থার বিকল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সীমাবদ্ধতা:
- আর্থিক সীমাবদ্ধতা: রাষ্ট্র এই স্যাটেলাইট থেকে এখনও পর্যাপ্ত অর্থ আয় করতে পারছে না। যদিও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে, তবুও তা প্রত্যাশিত মাত্রায় পৌঁছায়নি।
- প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা: মহাকাশে প্রায় ৫০টির বেশি দেশের দুই হাজারেরও বেশি স্যাটেলাইট বিদ্যমান। তাই স্যাটেলাইটের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ধরে রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
উপসংহার
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ বাংলাদেশের জন্য একটি বিশাল অর্জন এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তি এবং সম্প্রচার খাতে বৈশ্বিক মানচিত্রে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। স্যাটেলাইটটি দীর্ঘমেয়াদে দেশের সম্প্রচার ও টেলিযোগাযোগ সেক্টরে বিপ্লব ঘটাবে। যদিও অর্থনৈতিক আয়ের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবুও এর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা উজ্জ্বল এবং এর ব্যবহার দেশের উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
Source :