মাজার বিশ্বাস করা কি জায়েজ? কবর ও মাজার যিয়ারত

মাজার বিশ্বাস করা কি জায়েজ? কবর ও মাজার যিয়ারত


ইসলামে তাওহিদ তথা একত্ববাদকে কেন্দ্র করে ইবাদতের প্রচলন করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলার সত্তা ও গুণাবলির সঙ্গে অন্য কারো তুলনা করা, বা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ইবাদতের অংশীদার বানানো সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু আমাদের সমাজে মাজার পূজা, কবর তাওয়াফ, এবং পীর পূজা ইত্যাদি শিরকি কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে প্রচলিত। এই সমস্ত কর্মকাণ্ড ইসলামের মূল চেতনাকে ভঙ্গ করে এবং শিরক এর দিকে নিয়ে যায়, যা কোরআন ও হাদিসের দৃষ্টিতে কঠিন অপরাধ।

মাজার পূজার ইতিহাস এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট

ইসলাম প্রচারের শুরু থেকেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার অনুসারীদেরকে কবর সংক্রান্ত বাড়াবাড়ি সম্পর্কে সতর্ক করে গেছেন। হাদিসে স্পষ্টভাবে এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) কবরকে ইবাদতের স্থান হিসেবে গড়ে তোলার বিরুদ্ধে ছিলেন। এক বর্ণনায় তিনি বলেন,

“আল্লাহ, আমার কবরকে পূজার স্থান বানিয়ে দিও না।”
(মুসনাদে আহমদ)

কিন্তু এর বিপরীতে বর্তমানে বহু স্থানে মাজার ও পীর পূজার প্রচলন দেখা যায়। যেমন, মিশরে সায়্যেদ বদভীর মাজার, ভারতের আজমীরে খাজা মইনুদ্দিন চিশতীর মাজার এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জনপ্রিয় পীর-আউলিয়াদের মাজার। এখানে মানুষ গিয়ে কবর তাওয়াফ করে, যা একান্তভাবে কাবা ঘরের জন্যই নির্ধারিত একটি ইবাদত। এই কর্মকাণ্ড তাওহিদের মৌলিক ধারণার বিরোধী এবং ইসলামে তা শিরক হিসেবে গণ্য হয়।

মাজারের তাওয়াফ এবং ইসলামী বিধান

ইসলামে তাওয়াফ শুধুমাত্র কাবা ঘরের চারপাশে করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন:

“এবং তারা যেন এই সুসংরক্ষিত (পবিত্র) গৃহের তাওয়াফ করে।”
(সূরা হাজ্জ : ২৯)

তাওয়াফ করার মাধ্যমে আমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করি, যা কেবল কাবা ঘরের জন্যই নির্দিষ্ট। কিন্তু বিভিন্ন মাজারকে কেন্দ্র করে তাওয়াফ করা বা সেজদা করা ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অবৈধ। এটি বড় শিরক, যা মানুষের তাওহিদ বিশ্বাস ধ্বংস করে এবং তাকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়

কবরকে কেন্দ্র করে শিরক

কোরআন ও হাদিসের আলোকে আমরা জানতে পারি যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষকে কবরকে পূজার স্থান বানানোর বিরুদ্ধে সতর্ক করেছিলেন। এক বর্ণনায় তিনি বলেন:

“আল্লাহ, ওই জাতির ওপর অভিশাপ করেছেন যারা তাদের নবীদের কবরকে মসজিদ বানিয়েছে।”
(সহীহ মুসলিম)

এ থেকে বোঝা যায় যে, কবরকে কেন্দ্র করে ইবাদত করা বা কবরের উপর গম্বুজ নির্মাণ করা এবং তা পূজা-উপাসনার স্থানে পরিণত করা সম্পূর্ণ হারাম। কবরকে ইবাদতের স্থান বানানো, সেখানে বাতি জ্বালানো এবং সেজদা করা ইসলামের দৃষ্টিতে শিরক।

মাজার এবং পীর পূজা: ইসলামের দৃষ্টিতে শিরক

মাজার ও পীর পূজা এমন একটি প্রথা, যা সরাসরি ইসলামের তাওহিদিক বিশ্বাসের পরিপন্থী। মাজারে গিয়ে কিছু কামনা করা, কবরবাসীর কাছে প্রার্থনা করা, এবং পীরের নামে মান্নত করা শিরকি কর্মকাণ্ড। ইসলামে কেবলমাত্র আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা করা বৈধ এবং তিনি ছাড়া অন্য কারো কাছে সাহায্য কামনা করা শিরক। আল্লাহ তাআলা বলেন:

“তুমি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ডেকো না, যারা তোমার লাভ ও ক্ষতি করতে পারে না।”
(সূরা ইউনুস : ১০৬)

এছাড়াও, হাদিসে এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার উম্মতকে পীর পূজামাজার পূজা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। যারা এই শিরক কর্মে লিপ্ত হয়, তারা ইসলাম থেকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

মাজার কেন্দ্রিক বিদআত এবং শিরকি কর্মকাণ্ড

মাজার বিশ্বাস করা কি জায়েজ? এর উত্তর সহজেই দেওয়া যায়। ইসলামে মাজারে গিয়ে কিছু প্রার্থনা করা বা মাজারে গিয়ে ইবাদত করা একেবারেই জায়েজ নয়। বিভিন্ন মাজারে যে সমস্ত বিদআতি কর্মকাণ্ড ঘটে তা নিম্নে তুলে ধরা হলো:

  • কবর তাওয়াফ করা
  • কবরের উপরে মোমবাতি বা বাতি জ্বালানো
  • কবরকে পূজার স্থল বানানো
  • কবরবাসীর নামে মান্নত বা কোরবানি করা
  • কবরবাসীকে আল্লাহর রহমতের বণ্টনকারী মনে করা

এই সমস্ত কর্মকাণ্ড শিরক এবং বিদআত, যা মানুষের ঈমান নষ্ট করে এবং তাকে চিরস্থায়ী জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়।

সঠিক কবর যিয়ারত পদ্ধতি

ইসলামিক শরীয়তে কবর যিয়ারত একটি সুন্নত এবং তা সম্পূর্ণ ইবাদতমূলক একটি কর্ম। কিন্তু এর সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“তোমরা কবর যিয়ারত করো, তা তোমাদেরকে আখিরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে।”
(সহীহ মুসলিম)

কবর যিয়ারতের জন্য কিছু মাসনূন তরিকা আছে, যা মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি। সঠিক যিয়ারতের পদ্ধতি হলো:

  1. কবরের কাছে গিয়ে সালাম দেওয়া।
  2. কবরকে পিছনে রেখে কিবলামুখী হয়ে নিজের ও মৃত ব্যক্তির জন্য মাগফিরাত কামনা করা।
  3. কোরআনের কিছু অংশ তেলাওয়াত করে মৃত ব্যক্তির জন্য ইসালে ছওয়াব করা।

কবরকে ইবাদত বা পূজার স্থান বানানো সম্পূর্ণ হারাম, এবং এটিই ইসলামের দৃষ্টিতে সঠিক মাসনূন পদ্ধতি।

মাজার পূজা এবং সমাজে শিরকের প্রভাব

আজকের সমাজে পীর-মুরিদি, মাজার পূজা, এবং অবিশ্বাস থেকে শুরু করে নানা শিরকি কর্মকাণ্ড অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কিছু মানুষ সহজ-সরল মানুষের ঈমান নষ্ট করে মাজার ও পীরকে কেন্দ্র করে ব্যবসা খুলে বসেছে। কিছু ভণ্ড পীর মানুষকে বিভিন্ন ধরনের গায়েবি ক্ষমতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শিরকের পথে টেনে নিচ্ছে। এ ধরনের পীর-মাজার কেন্দ্রিক কর্মকাণ্ড ইসলামের সত্যিকার শিক্ষা থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখছে।

অনেক জায়গায় আমরা দেখতে পাই যে মাজারে গিয়ে সেজদা দেওয়া হয়, কবরবাসীর নামে মান্নত করা হয়, এবং জীবিত পীরদের আল্লাহর প্রতিনিধির মতো মনে করা হয়। এই সমস্ত কার্যকলাপ ইসলামের মৌলিক চেতনাকে ধ্বংস করে এবং মানুষের ঈমানকে দুর্বল করে দেয়।

মাজার ও শিরক থেকে মুক্ত থাকার উপায়

মাজার পূজা এবং শিরক থেকে মুক্ত থাকার জন্য আমাদের ইসলামের মূল শিক্ষাকে মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি। আল্লাহ তাআলা বলেন:

“নিশ্চয় শিরক হচ্ছে বড় জুলুম।”
(সূরা লুকমান : ১৩)

শিরক থেকে বাঁচতে হলে আমাদের কোরআনহাদিসের নির্দেশনাগুলো মেনে চলতে হবে।

  1. তাওহিদে বিশ্বাস দৃঢ় করতে হবে।
  2. কেবল আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে হবে।
  3. মাজারে গিয়ে ইবাদত বা সেজদা করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
  4. বিদআত ও শিরক থেকে দূরে থাকা এবং সমাজে এই বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা উচিত।
  5. ভণ্ড পীরদের থেকে দূরে থাকা এবং ইসলামের সত্যিকার শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।

উপসংহার

মাজার বিশ্বাস করা এবং মাজারে গিয়ে ইবাদত করা ইসলামিক শরিয়তের সম্পূর্ণ বিরোধী। এটি ইসলামের তাওহিদিক বিশ্বাসকে নষ্ট করে এবং মানুষকে শিরকের দিকে নিয়ে যায়। শিরক ইসলামের সবচেয়ে বড় অপরাধ এবং যারা শিরকের পথে চলে, তাদের জন্য আল্লাহ জান্নাত হারাম করে দেন

আমাদের সকলের উচিত কোরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী জীবনযাপন করা, এবং সকল প্রকার শিরক এবং বিদআত থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখা। মাজার বিশ্বাস করা কি জায়েজ? এর উত্তর একবাক্যে বলা যায়—এটি জায়েজ নয়, বরং এটি শিরক এবং ইসলামের মূল চেতনার সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সাংঘর্ষিক।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক পথ দেখান এবং শিরক ও বিদআত থেকে মুক্ত থাকার তাওফিক দিনআমিন।

Source :

https://muslimbangla.com/masail/11884

https://www.hadithbd.com/books/link/?id=1640

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url