মব জাস্টিস কী? সমাজে এর গুরুত্ব, প্রভাব ও প্রতিরোধের উপায়
মব জাস্টিস বলতে বোঝায়, উত্তাল বা হুজুগে জনতার দ্বারা নির্ধারিত বিচারের পদ্ধতি। এই প্রপঞ্চের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ নিজেদের হাতে আইন তুলে নেয় এবং অপরাধী হিসেবে সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে শাস্তি প্রদান করে। সাধারণত বিচারের জন্য নিয়মতান্ত্রিক ও আইনসঙ্গত প্রক্রিয়া অপেক্ষা না করেই এই শাস্তি প্রদান করা হয়। তবে, এই ধরণের বিচার ব্যবস্থা খুবই বিপজ্জনক, কারণ এতে বিচার ও শাস্তির মধ্যে কোনো তফাৎ থাকে না, এবং নিরপেক্ষতার অভাব থাকে। মব জাস্টিস এর ফলে জনমনে সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থার প্রতি অবিশ্বাস তৈরি হয় এবং সমাজে বিচারহীনতার সংস্কৃতি জন্ম নেয়।
মব জাস্টিসের সংজ্ঞা ও বিবর্তন
মব জাস্টিসের মূল ধারণা শুরু হয় তখন, যখন একটি জনসমাবেশ আইন বা বিচার ব্যবস্থার প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে এবং উত্তেজনার মুহূর্তে নিজেরাই আইন হাতে তুলে নেয়। এটি সমাজের ন্যায়বিচার ও সাংবিধানিক শাসনের প্রতি চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে। মব লিঞ্চিং (lynching) হলো এর সবচেয়ে চরম রূপ, যেখানে উত্তেজিত জনতা কারও বিচার বহির্ভূত হত্যার জন্য দায়ী হয়ে ওঠে। ইতিহাসে মব লিঞ্চিংয়ের অনেক উদাহরণ রয়েছে, যেমন পাকিস্তানে মাশাল খানকে ব্লাসফেমির অভিযোগে হত্যা করা হয়েছিল, এবং ভারতে গোহত্যার অভিযোগে কয়েকজন নিরীহ মানুষ মব লিঞ্চিংয়ের শিকার হয়েছেন।
মব লিঞ্চিং কেবল হত্যার মাধ্যমে ঘটে না, অনেক সময় গণপিটুনির (mass beating) মাধ্যমে জনতা অপরাধীকে শাস্তি দেয়। মব জাস্টিসের এসব ঘটনায় গণপিটুনি, ধ্বংসযজ্ঞ এবং অন্যায়ভাবে দণ্ড দেয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। তাই মব জাস্টিস একটি সামাজিক সমস্যা হিসেবে প্রতিনিয়ত আলোচিত হচ্ছে।
মব জাস্টিসের বিভিন্ন প্রকারভেদ
ব্লুমার এবং ব্রাউন এর মতে, জনতাকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যায়, যেমন:
- আকস্মিক জনতা (Casual Crowd): কোনো আকস্মিক ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়।
- রীতিগত জনতা (Conventional Crowd): পূর্বনির্ধারিত কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়।
- সক্রিয় জনতা (Active Crowd): সংঘাতমুখী বা উত্তেজিত জনতা।
- অভিব্যক্তিপূর্ণ জনতা (Expressive Crowd): আবেগপ্রবণ আচরণে সম্পৃক্ত জনতা।
সক্রিয় জনতা সাধারণত মবের রূপ ধারণ করে, যেখানে উচ্ছৃঙ্খলতা ও ধ্বংসাত্মক আচরণ দেখা যায়। এর মধ্যে বিশেষ করে মারপিট, ভাঙচুর ও অগ্নি সংযোগের মতো ঘটনা ঘটে থাকে।
মব লিঞ্চিংয়ের উদাহরণ ও প্রভাব
মব লিঞ্চিংয়ের ইতিহাস খুবই পুরনো। অতীতে যেমন ব্লাসফেমি (ধর্ম অবমাননা) অথবা জাতিগত বিদ্বেষের কারণে মানুষকে মব লিঞ্চিংয়ের শিকার হতে হয়েছে, ঠিক তেমনি আজও তা ঘটে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়:
- পাকিস্তানের মাশাল খান হত্যা: বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে মাশাল খানকে উত্তেজিত জনতা নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছিল।
- ভারতে গোহত্যা ও গোমাংস বহনের অভিযোগে হত্যা: ভারতে সন্দেহের বশে অনেক নিরীহ মানুষকে মব লিঞ্চিংয়ের শিকার হতে হয়েছে।
মব লিঞ্চিং সাধারণত সামাজিক, ধর্মীয়, অথবা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ঘটে থাকে। এতে মবের হাতে মানুষ বিচারহীনতার শিকার হয়। একদিকে এটা সমাজের ভয়ঙ্কর বাস্তবতা, অন্যদিকে এর প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে জনগণের মনোভাবেও প্রভাব ফেলে।
জনতার আচরণ: সমাজ মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ
সমাজ মনোবিজ্ঞানে জনতা বা Crowd Behavior গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত। জনতার আচরণের মূল বৈশিষ্ট্য হলো তাদের আচরণে শৃঙ্খলা ও নিয়মের অভাব। যখন জনতা উত্তেজিত হয়, তখন তারা সাধারণভাবে আইন বা বিচার প্রক্রিয়া মানতে চায় না। মনোবিজ্ঞানীরা জনতার আচরণের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করেছেন, যেমন:
- মানসিক সমরূপতা (Mental Homogeneity): জনতায় উপস্থিত ব্যক্তিদের চিন্তা ও আচরণ এক অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে, যার ফলে তাদের মধ্যে সমরূপতা দেখা যায়।
- আবেগপ্রবণতা (Emotionality): জনতা সাধারণত খুবই আবেগতাড়িত হয় এবং হিংস্রতার দিকে ঝুঁকে পড়ে।
- বিচারশক্তিহীনতা (Irrationality): উত্তেজিত জনতা নিজের বিচারবুদ্ধি হারিয়ে ফেলে এবং ভালো-মন্দের পার্থক্য করতে অক্ষম হয়।
- দায়িত্ববোধের অবনতি (Diminished Sense of Responsibility): জনতা মনে করে তারা দায়িত্বহীন, কারণ একা নয়, তারা পুরো গোষ্ঠীর অংশ হিসেবে কাজ করছে।
- ক্ষমতাবোধ (Sense of Power): জনতা মনে করে তাদের ক্ষমতা অসীম, এবং কেউ তাদের বাধা দিতে পারবে না।
- অনামিত্ব বোধ (Sense of Anonymity): জনতা মনে করে তাদের পরিচয় গোপন থাকবে, তাই তাদের কোনো শাস্তি ভোগ করতে হবে না।
মব জাস্টিসের সামাজিক প্রভাব ও এর প্রতিরোধ
মব জাস্টিসের ফলে সমাজে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এর ফলে সাধারণ মানুষ বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং আইন হাতে তুলে নেয়। মব জাস্টিস ও মব লিঞ্চিং জনমনে আতঙ্ক তৈরি করে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে।
মব জাস্টিস প্রতিরোধের উপায়সমূহ:
- আইনের সঠিক প্রয়োগ: মব জাস্টিস রোধের জন্য সবার আগে প্রয়োজন আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ। অপরাধীদের শাস্তি আইন অনুযায়ী দিতে হবে এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে।
- জনসচেতনতা বৃদ্ধি: জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে যেন মব জাস্টিসের মত কার্যকলাপ সমাজে স্বীকৃতি না পায়।
- শিক্ষা ও গণমাধ্যমের ভূমিকা: গণমাধ্যম ও শিক্ষাব্যবস্থা জনগণের মাঝে মব লিঞ্চিং ও মব জাস্টিসের বিপজ্জনক দিকগুলো তুলে ধরতে পারে।
- উস্কানি ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য বন্ধ করা: কোনো ধর্মীয়, সামাজিক বা রাজনৈতিক বক্তব্য যা হিংসা ছড়ায়, তা কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে।
- দ্রুত ও ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা: যদি বিচারব্যবস্থা দ্রুততার সাথে ন্যায়বিচার প্রদান করে, তবে সাধারণ মানুষ মব জাস্টিসের প্রতি নির্ভরশীল হবে না।
- মব কন্ট্রোল টেকনিক্স: জনতাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর আধুনিক প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, যেন তারা সংঘাত ও সহিংসতা মোকাবেলায় সক্ষম হয়।
কেন মব জাস্টিস বিপজ্জনক?
মব জাস্টিস সবসময়ই যুক্তিহীন, আবেগনির্ভর এবং বিপজ্জনক। এতে সত্যিকারের অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়, বরং নিরীহ ব্যক্তিরা শাস্তির শিকার হয়ে থাকে। মব লিঞ্চিংও সামাজিক স্থিতিশীলতাকে বিঘ্নিত করে এবং আইন-শৃঙ্খলার প্রতি জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলে।
মব জাস্টিস এমন একটি প্রক্রিয়া যা বিচারব্যবস্থার বিকল্প নয়। বরং এটি সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। যখন কোন অপরাধ সংঘটিত হয়, তখন আমাদের উচিত সেই অপরাধের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ ও আইনসঙ্গত পন্থায় ব্যবস্থা নেয়া, মবের উপর ভরসা করা নয়।
উপসংহার
মব জাস্টিসের ধারণা সমাজে একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের মব জাস্টিসের মত ক্ষতিকারক প্রবণতাগুলো প্রতিরোধ করতে হবে। এর জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি, আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ, এবং শিক্ষাব্যবস্থা ও গণমাধ্যমের সমন্বিত ভূমিকা প্রয়োজন। এছাড়া বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ও ঘৃণা ছড়ানোর প্রবণতাও বন্ধ করতে হবে।
মব জাস্টিস কি কখনও ইতিবাচক হতে পারে না। এই প্রক্রিয়াটি বিচারহীনতার সংস্কৃতির প্রতিফলন, যা সমাজের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করে। বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখতে হবে এবং অপরাধীদের শাস্তি দিতে আইন ও প্রশাসনের ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে। জনতার উত্তেজনার মুখে বিচারপ্রক্রিয়া নষ্ট হতে পারে না, বরং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আমাদের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
Source :
https://www.thedailystar.net/shout/news/everything-wrong-mob-justice-3124051
https://www.sciencedirect.com/science/article/abs/pii/S1756061622000519