ইদ্দত কী? ইদ্দতের সময়কাল, প্রকারভেদ এবং ইসলামের বিধান

ইদ্দত কী? ইদ্দতের সময়কাল, প্রকারভেদ এবং ইসলামের বিধান


ইসলামী শরীয়তে নারীর ইদ্দত একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। ইদ্দত মানে হলো নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নারীর অন্যত্র বিয়ে করা থেকে বিরত থাকা। এটি তালাক বা স্বামীর মৃত্যু ঘটলে নারীর জন্য পালনীয় এক বিধান। ইদ্দতের মাধ্যমে দেখা যায় যে, নারী গর্ভবতী কি না, এবং সেই প্রেক্ষিতে শরীয়তসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ইসলাম ইদ্দতের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর জন্য কিছু বিধান নির্ধারণ করেছে, যা উভয়ের জন্যই কল্যাণকর।

ইসলামে ইদ্দত মূলত পারিবারিক জীবনকে সুরক্ষিত করার জন্য নির্ধারিত একটি প্রক্রিয়া। তালাক বা স্বামীর মৃত্যু হলে ইদ্দত নারীর জন্য আবশ্যিক হয়ে যায়, এবং তা তাদের পরবর্তী জীবনকে স্থিতিশীল করার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়। এই প্রবন্ধে আমরা ইদ্দতের পুরো ধারণা, এর সময়কাল, কেন ইদ্দত পালন করা হয়, এবং ইদ্দতের গুরুত্ব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।


ইদ্দত শব্দের শাব্দিক অর্থ

ইদ্দত শব্দটি আরবি عدة থেকে এসেছে, যার শাব্দিক অর্থ হলো "গণনা করা" বা "গণিত করা"। এর মূল তাৎপর্য হচ্ছে নির্দিষ্ট সময়কাল গণনা করে সেই সময় পর্যন্ত নারীর অন্য কোনো বিবাহে বন্ধনে আবদ্ধ না হওয়া। এটি মূলত নারীর আগের বিবাহের প্রভাবকে নির্ধারণ করার একটি সময়কাল, বিশেষ করে নারী গর্ভবতী কিনা তা নির্ণয়ের জন্য। ইসলামের বিধান অনুযায়ী, একজন নারীকে এই সময়ের মধ্যে তার জীবনযাত্রা নির্ধারণ করতে হয় এবং শরীয়তের নির্ধারিত বিধানগুলো মেনে চলতে হয়।


ইসলামে ইদ্দতের ইতিহাস

ইদ্দতের বিধান ইসলামপূর্ব যুগে ছিল না। জাহিলিয়্যাতের যুগে লোকেরা তালাক দেওয়ার ক্ষেত্রে অযথা তাড়াহুড়া করতো। কোনোরকম বিবেচনা বা চিন্তা ছাড়াই তারা একাধিক তালাক দিয়ে স্ত্রীদের সাথে সম্পর্ক শেষ করতো। এই তালাকের মাধ্যমে নারী, সন্তান এবং স্বামী উভয়ের জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হতো।

ইসলাম এই অযৌক্তিক প্রথার অবসান ঘটিয়ে তালাক ও ইদ্দতের নিয়ম চালু করেছে। ইসলাম বলেছে, যদি তালাক দেওয়ার প্রয়োজন হয়, তবে সঠিকভাবে ইদ্দতের সময়কাল মেনে চলা উচিত এবং সেই সময়কে গণনা করা উচিত। এর ফলে স্ত্রীর গর্ভধারণের সম্ভাবনাসহ অন্যান্য বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ নেওয়া যায়।


ইদ্দত পালন করার কারণ

ইদ্দত পালন করার অন্যতম কারণ হলো নারীর গর্ভাবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহ একটি পবিত্র সম্পর্ক এবং সেই সম্পর্কের কোনো ক্ষতি হলে শরীয়তসম্মত নিয়ম অনুযায়ী নারীর জন্য নতুন বিবাহের অনুমতি দেওয়া হয়। তবে ইদ্দত পালনের সময়কালে সেই অনুমতি মুলতুবি রাখা হয়। ইদ্দত নারীর শরীর ও মনের জন্যও একটি পুনরুদ্ধারের সময় হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি নারীর নতুন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আগে মানসিক এবং শারীরিক স্থিতিশীলতার দিকে মনোযোগ দেয়।


ইদ্দতের প্রকারভেদ

ইদ্দতের বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে, এবং তা নির্ভর করে বিবাহ বিচ্ছেদের ধরন ও শারীরিক পরিস্থিতির ওপর। নিম্নে ইদ্দতের কিছু প্রকারভেদ উল্লেখ করা হলো:

  1. তালাকের ইদ্দত: তালাকপ্রাপ্ত নারীকে হায়েয (মাসিক) এর তিনটি সময়কাল পর্যন্ত ইদ্দত পালন করতে হয়।
  2. মৃত্যুর ইদ্দত: যদি স্বামী মৃত্যুবরণ করে, তবে নারীর ইদ্দতের সময়কাল চার মাস দশ দিন
  3. গর্ভবতী নারীর ইদ্দত: গর্ভবতী নারীর ক্ষেত্রে ইদ্দতের সময় হলো সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত।
  4. বিধবা নারীর ইদ্দত: বিধবা নারীর জন্য ইদ্দতের সময় হলো চার মাস দশ দিন।
  5. তাযকিয়ার ইদ্দত: নারীর সন্দেহভাজন গর্ভাবস্থা বা সন্তানের পরিচয় নিশ্চিত করতে এই ইদ্দত পালন করা হয়।

তালাকের ক্ষেত্রে ইদ্দতের গুরুত্ব

তালাকের পর নারীর জন্য ইদ্দতের সময় পালন করা বাধ্যতামূলক। এই সময়ে নারী কোনো পুরুষের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে না। ইদ্দতের সময় স্বামী চাইলে আবার স্ত্রীকে গ্রহণ করতে পারে, তবে ইদ্দত পার হলে সেই অধিকার থাকবে না।

তালাকের ইদ্দত পুরুষের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। স্বামী তালাক দেওয়ার পরে যদি তার স্ত্রীর গর্ভাবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চায়, তবে ইদ্দতের মাধ্যমে তা জানা যায়। এছাড়াও, এই সময়ের মধ্যে স্বামী ও স্ত্রী উভয়ে আবার সমঝোতার সুযোগ পেতে পারে।


বিধবা নারীর ইদ্দত

বিধবা নারীর ইদ্দত হচ্ছে স্বামীর মৃত্যুর পর পালিত এক বিশেষ সময়কাল। এই ইদ্দতটি পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো নারীকে মানসিক ও শারীরিকভাবে স্থিতিশীল করা এবং তাকে সামাজিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত করা। স্বামীর মৃত্যুর পর নারীকে চার মাস দশ দিন ইদ্দত পালন করতে হয়। তবে যদি নারী গর্ভবতী থাকে, তাহলে সন্তানের জন্ম না হওয়া পর্যন্ত ইদ্দত অব্যাহত থাকে।


ইদ্দতের সময়কাল

ইদ্দতের সময়কাল তালাক বা স্বামীর মৃত্যুর ক্ষেত্রে ভিন্ন হতে পারে:

  • তালাকপ্রাপ্ত নারীর জন্য: তালাকের পরে নারীর জন্য ইদ্দতের সময়কাল তিনটি হায়েয সময়কাল পর্যন্ত।
  • মৃত্যুর ক্ষেত্রে: স্বামীর মৃত্যুর পরে ইদ্দতের সময়কাল চার মাস দশ দিন। তবে গর্ভবতী হলে সন্তান প্রসবের সময় পর্যন্ত ইদ্দত পালন করতে হয়।
  • নারী হায়েয পায় না: যে নারী মাসিক পায় না, তার ক্ষেত্রে ইদ্দতের সময়কাল তিন মাস।

ইদ্দতের সময়ের বিধান

ইদ্দতের সময় নারীর জীবনযাত্রার উপর কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে:

  1. ঘরে অবস্থান: ইদ্দতের সময় নারীর জন্য স্বামীর বাড়িতে অবস্থান করা আবশ্যক। শরীয়তসম্মত প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হওয়া উচিত নয়
  2. সাজসজ্জা পরিহার: ইদ্দতের সময় নারীর জন্য সাজসজ্জা, অলংকার, এবং সৌন্দর্য প্রকাশের পোশাক পরা নিষিদ্ধ।
  3. বিবাহ প্রস্তাব গ্রহণ: ইদ্দতের সময়কালে নারীর জন্য স্পষ্ট বিবাহ প্রস্তাব গ্রহণ করা বা প্রস্তাব দেওয়া নিষিদ্ধ, তবে ইঙ্গিতে প্রস্তাব দেওয়া যাবে।
  4. আবশ্যকীয় কারণ ছাড়া বের হওয়া নিষেধ: ইদ্দতের সময় নারীর শুধুমাত্র জরুরি প্রয়োজনেই বাইরে যাওয়া বৈধ।

ইদ্দত সম্পর্কে প্রচলিত ভুল ধারণা

অনেক জায়গায় ইদ্দত সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে, যা শরীয়ত সম্মত নয়। যেমন, স্বামীর মৃত্যুর পর ৪৫ দিনের ইদ্দত পালন করে নারীদের পিত্রালয়ে ফেরত পাঠানো হয়। এটি শরীয়ত অনুযায়ী ভুল। স্বামীর মৃত্যুর পর নারীর জন্য চার মাস দশ দিন ইদ্দত পালন আবশ্যক এবং এই সময়ে তাকে স্বামীর বাড়িতে অবস্থান করতে হবে। ইদ্দত পূর্ণ হওয়ার আগে নারীর অন্যত্র যাওয়া বা নতুন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ নয়।


ইদ্দতের সময় নারীর করণীয়

ইদ্দতের সময় নারীর জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ করণীয় আছে, যা শরীয়ত নির্দেশিত:

  • প্রয়োজন ব্যতিরেকে ঘরের বাইরে না যাওয়া।
  • সাধারণ পোশাক পরিধান করা।
  • অলঙ্কার এবং মেক-আপ পরিহার করা।
  • সুগন্ধি এবং সৌন্দর্য প্রসাধন ব্যবহার থেকে বিরত থাকা।

ইদ্দত এবং ইসলামী সমাজে এর গুরুত্ব

ইদ্দত নারীর মানসিক ও শারীরিক স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং সামাজিক জীবনে তার যথার্থ অবস্থান রক্ষা করে। ইসলামী সমাজে ইদ্দত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধান যা পুরুষ ও নারীর সম্পর্ককে সুরক্ষিত রাখে এবং তাদের সামাজিক মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখে।


উপসংহার

ইসলামের ইদ্দত একটি আধ্যাত্মিক এবং পারিবারিক সুরক্ষার ব্যবস্থা, যা নারীর জন্য বিধান করেছে। এটি নারীর জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সময়কাল হিসেবে কাজ করে এবং তাকে ভবিষ্যতের জন্য মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুত করে। ইদ্দত কী এবং কেন এটি পালন করা হয় তা ইসলামের বিশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী সমাজকে সচেতন করা অত্যন্ত জরুরি।

ইদ্দত নিয়ে যে সব ভুল ধারণা রয়েছে তা দূর করার মাধ্যমে ইসলামী সমাজকে আরও সুরক্ষিত এবং সুস্থ রাখা সম্ভব।

References :

1. https://www.jagonews24.com/religion/islam/811266

2. https://www.hadithbd.com/books/detail/?book=1&chapter=491

3. https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%87%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A6%A4


মুসলিম আইনে ইদ্দত কি?

ইদ্দত হল একটি ইসলামিক ধারণা যা মুসলিম বিবাহের বিলুপ্তির পর অপেক্ষার সময়কে বোঝায়। এটি একটি বাধ্যতামূলক ইদ্দতকাল যেখানে মহিলা পুনরায় বিয়ে করতে পারবেন না। ইদ্দতের উদ্দেশ্য হল নতুন বিয়ে করার আগে মহিলাটি যেন গর্ভবতী না হয় তা নিশ্চিত করা। ইসলামী আইনে, ইদ্দতের সময়কাল তালাকের পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়।

মহিলাদের ইদ্দত কত দিন?

(গর্ভবতী না হলে) একজন স্বাধীন নারী বিধবার ইদ্দত হয়, চার মাস দশ দিন। সেই মহিলার সাথে সহবাস করুক আর না করুক, মুসলিম হোক বা কিতাবী। তাই বুঝা গেল, স্বাধীন নারী বিধবা গর্ভবতী না হলে ইদ্দত হবে চার মাস দশ দিন।

তালাকের পর ইদ্দত কত দিন?

কোরআনে কারিমে আল্লাহ বলেন, সব সধবা নারীরাও বিবাহের ক্ষেত্রে তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ। (সুরা নিসা, আয়াত-২৪) কোনও বিবাহিতা নারী যদি তার স্বামীর পক্ষ থেকে তালাকপ্রাপ্তা হন এবং তিন মাস (তিনটি পিরিয়ড) ইদ্দত পালন শেষ করেন শুধুমাত্র তাহলেই তিনি নতুন করে বিবাহের বৈধতা পাবেন।

স্বামী মারা গেলে ইদ্দত কত দিন?

স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীর জন্য স্বামীর বাড়িতে (স্বামীর জীবদ্দশায় সে যেখানে বসবাস করত) চার মাস দশ দিন ইদ্দত পালন করা জরুরি। চার মাস দশ দিন শেষ হওয়ার আগে শরীয়তসম্মত প্রয়োজন ছাড়া তার জন্য সেখান থেকে পিত্রালয় বা অন্যত্র স্থানান্তর হওয়া জায়েজ নয়।

ইসলামে মৃত্যুর পর স্বামী স্ত্রীকে দেখতে পারবে কি?

স্বামীর জন্য তার মৃত স্ত্রীর মৃতদেহের দিকে তাকানো, তাকে গোসল করা, তাকে কাফন দেওয়া জায়েজ এবং তাকে তার কবরে রাখার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url