ইরানের বর্তমান সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা কে?

ইরানের বর্তমান সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা কে?


ইরানের বর্তমান সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা হলেন আয়াতুল্লাহ সৈয়দ আলী হোসেনী খামেনেয়ী। তিনি ১৯৮৯ সাল থেকে ইরানের দ্বিতীয় এবং বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ইসলামী বিপ্লবের পর খামেনেয়ী ইরানের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করে আসছেন। এর আগে তিনি ১৯৮১ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ইরানের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী শাসক, এবং মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভির পর ইরানের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতায় থাকা নেতা। তাঁর ক্ষমতা এবং প্রভাব ইরান এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে বিশেষভাবে লক্ষণীয়।


আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর রাজনৈতিক যাত্রা ও নেতৃত্ব

খামেনেয়ীর রাজনৈতিক জীবনের শুরু হয় ইসলামী বিপ্লবের আগে থেকেই। মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভির শাসনামলে তাঁকে ছয়বার গ্রেফতার করা হয় এবং তিন বছরের জন্য নির্বাসিত করা হয়। ১৯৮১ সালে তাঁকে গুপ্তহত্যার প্রচেষ্টা চালানো হয়, যার ফলে তাঁর ডান হাত আজীবন অসাড় হয়ে পড়ে। এরপর থেকে তিনি ইরানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে গড়ে ওঠেন।

ইরান-ইরাক যুদ্ধকালীন সময়ে, খামেনেয়ী ইরানের সামরিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করেন এবং ইসলামি বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তিনি এই শক্তিশালী বাহিনীটির নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি তাদের কমান্ডারদের নির্বাচন ও অপসারণের ক্ষমতাও রাখেন। তাঁর নেতৃত্বে বিপ্লবী রক্ষীবাহিনী ইরানের বিরোধীদের দমনেও বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত খামেনেয়ী ইরানের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৮৯ সালে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনীর মৃত্যুর পর খামেনেয়ীকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। আকবর হাশেমী রফসঞ্জানীর মতে, মৃত্যুর পূর্বে খোমেনী নিজে খামেনেয়ীকে তাঁর উত্তরসূরী হিসেবে মনোনীত করে গিয়েছিলেন।


ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার ক্ষমতা ও ভূমিকা

ইরানের সংবিধান অনুযায়ী, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা দেশটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক, সামরিক বাহিনীর প্রধান এবং ফরমান জারিকারী হিসেবে কাজ করেন। আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী ইরানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও ধর্মীয় সমস্ত বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখেন। তাঁর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগের উপর।

এছাড়াও, খামেনেয়ী গার্ডিয়ান কাউন্সিলের সদস্যদের মনোনীত করেন যারা বিশেষজ্ঞ পরিষদ, রাষ্ট্রপতি ও মজলিসের সকল পদপ্রার্থীদের পুননিরীক্ষণ করে। এই পরিষদগুলোর সদস্যরা মূলত খামেনেয়ীর সমর্থনপুষ্ট হওয়ায়, তিনি তার ক্ষমতাকে বজায় রাখতে সক্ষম হন। তার অধীনে ইরানের ইসলামিক বিপ্লবী গার্ড কর্পস (IRGC) এর প্রভাব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তারা দেশটির সামরিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে।


আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি

আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে একটি ফতোয়া জারি করেন। তাঁর মতে, ইসলামিক বিধান অনুযায়ী পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার হারাম বা নিষিদ্ধ। তিনি এই ফতোয়ায় বলেন, ইরান তার পরমাণু কার্যক্রম শুধুমাত্র শান্তিপূর্ণভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যই পরিচালনা করছে। যদিও ইসরায়েল ও কিছু পশ্চিমা দেশ অভিযোগ করে যে ইরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে, ইরান সবসময়ই এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।

খামেনেয়ী বলেন, “আমাদের দেশের শক্তি তেল ও গ্যাসের উপর নির্ভর করে না, আমরা বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দিকে নজর রাখছি।” ইরানের এই নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশ ইরানের উপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে আসছে।


আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর ধর্মীয় জীবন ও ভাষাগত দক্ষতা

খামেনেয়ী একজন দক্ষ ধর্মীয় নেতা এবং তিনি বহু বছর ধরে ইসলামিক শিক্ষা ও তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত আছেন। তাঁর ভাষাগত দক্ষতাও অনন্য। খামেনেয়ী উত্তমভাবে আরবি বলতে পারেন এবং তাঁর মাতৃভাষা ফার্সি। এছাড়া তিনি আরবি থেকে ফার্সিতে একাধিক বই অনুবাদ করেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বিখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ সৈয়দ কুতুবের কাজ। তিনি কিছুটা ইংরেজি বুঝতে পারেন এবং তাঁর পিতার মাতৃভাষা আজারবাইজানি ভাষাতেও কথা বলতে পারেন।


ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা কীভাবে নির্বাচন করা হয়?

ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা নির্বাচনের দায়িত্ব রয়েছে বিশেষজ্ঞ পরিষদে। এই পরিষদের ৮৮ জন সদস্য ইরানের শীর্ষস্থানীয় ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব যারা প্রতি আট বছর অন্তর নির্বাচিত হন। তবে, বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্যদের মনোনয়নের আগে গার্ডিয়ান কাউন্সিলের অনুমোদন নিতে হয়। আর এই গার্ডিয়ান কাউন্সিলের সদস্যরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার দ্বারা মনোনীত হন, যা খামেনেয়ীর প্রভাবকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

খামেনেয়ীর মৃত্যুর পর, ইরানের পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে মোজতবা খামেনেয়ী অথবা এব্রাহিম রাইসি-কে বিবেচনা করা হতে পারে। তবে, বর্তমান প্রক্রিয়া অনুযায়ী গার্ডিয়ান কাউন্সিল এবং ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড নতুন নেতা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম।


আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর উত্তরসূরী কে হতে পারেন?

খামেনেয়ীর উত্তরসূরী নিয়ে জল্পনা-কল্পনা ইরান এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। খামেনেয়ীর সবচেয়ে বড় ছেলে মোজতবা খামেনেয়ী এবং বিচার বিভাগের প্রধান এব্রাহিম রাইসি সম্ভাব্য উত্তরসূরী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন। মোজতবা খামেনেয়ী রেভল্যুশনারি গার্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখেন এবং ২০০৯ সালের ইরানি বিক্ষোভের সময় তাঁর নেতৃত্বে এই গার্ড আন্দোলন দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

অন্যদিকে, এব্রাহিম রাইসি একটি প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা এবং তিনি খামেনেয়ীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তিনি ইরানের বিচার বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন এবং দুর্নীতি বিরোধী কার্যক্রম শুরু করেছেন। তাঁরও ইরানের পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হতে পারে।


আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ও সমর্থন

খামেনেয়ী ইরানের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির অন্যতম সমর্থক। তিনি দেশের উন্নয়নের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের উপর জোর দিয়েছেন। ২০০৪ সালে তিনি বলেন, একটি দেশের সমৃদ্ধি সেই দেশের বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের উপর নির্ভর করে।

ইরান বর্তমানে জৈবিক গবেষণায় অগ্রসর হয়েছে এবং খামেনেয়ীর সমর্থন এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাঁর নেতৃত্বে ইরান জৈবপ্রযুক্তি, ন্যানোটেকনোলজি এবং মেডিকেল রিসার্চের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে।


আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর মানবাধিকার ও পররাষ্ট্রনীতি

আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী মানবাধিকারকে ইসলামী শিক্ষার একটি মূল ভিত্তি হিসেবে গণ্য করেন। তিনি মনে করেন ইসলামিক মানবাধিকার বেঁচে থাকার অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার প্রদান করে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক নিয়ে খামেনেয়ীর কঠোর অবস্থান রয়েছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে সন্ত্রাসবাদের সমর্থক হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন এবং ২০০১ সালের ৯/১১ হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তানে সামরিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তাঁর মতে, পশ্চিমা দেশগুলো ইসলামী দেশগুলোর উপর অর্থনৈতিক শোষণ ও স্বৈরশাসন চাপিয়ে দিচ্ছে।


ইরানের পরমাণু ক্ষমতা ও আন্তর্জাতিক অবস্থান

ইরানের পরমাণু কার্যক্রম আন্তর্জাতিক মঞ্চে বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খামেনেয়ী পরমাণু অস্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন এবং বলেছেন যে ইরান পরমাণু শক্তি শুধুমাত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে যে ইরান গোপনে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে, তবে এই অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।


উপসংহার

আয়াতুল্লাহ সৈয়দ আলী খামেনেয়ী ইরানের বর্তমান সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা এবং তাঁর নেতৃত্বে ইরান আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান দখল করেছে। তাঁর ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং সামরিক নেতৃত্বে ইরান অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্থিতিশীলতা বজায় রেখেছে। তাঁর উত্তরসূরী নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, তিনি এখনো ইরানের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি।


ইরানের প্রধান ধর্মীয় নেতা কে?

সৈয়দ আলী হোসেইনী খামেনেয়ী (ফার্সি: سید علی حسینی خامنه‌ای; জন্ম ১৯ এপ্রিল ১৯৩৯) হলেন একজন ইরানি শিয়া মুসলিম ধর্মগুরু এবং ১৯৮৯ সাল থেকে ইরানের দ্বিতীয় ও বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা।

ইরানের মানুষ কি ধার্মিক?

78% ইরানি বিশ্বাস করে যে ধর্ম তাদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই সমীক্ষায় আরও দেখা গেছে যে 38% ইরানি সাপ্তাহিক উপাসনা সেবায় যোগ দেয়।

ইরানের সেনাবাহিনীর নাম কি?

ইরানের ইসলামিক প্রজাতন্ত্র সেনাবাহিনী ( ফার্সি : ارتش جمهوری اسلامی ایران ), সংক্ষিপ্ত নাম AJA ( ফার্সি : آجا ), যা কেবল ইরানী সেনাবাহিনী বা আর্তেশ ( ফার্সি : ارتش , রোমানাইজড : Arteš, (Ərtēš) ) নামে পরিচিত। ইরানের প্রচলিত সামরিক বাহিনী এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর অংশ।

ইরানের আইনসভার নাম কি?

ইসলামিক কনসালটেটিভ অ্যাসেম্বলি ( ফার্সি : مجلس شورای اسلامی , রোমানাইজড : Majles-e Showrā-ye Eslāmī ), যাকে ইরানী সংসদও বলা হয়, ইরানী মজলেস (আরবি বানান মজলিস ) বা আইসিএ হল ইরানের জাতীয় আইনসভা ।

ইরানের পূর্ব নাম কি ছিল?

প্রায় ২০০০ বছর ধরে এ অঞ্চলের অধিবাসীরা নিজেদের দেশকে "ইরান" নামে ডাকত। ইরান নামটি এই এলাকায় বসতি স্থাপনকারী আর্য গোত্রের নাম থেকে নেয়া। কিন্তু গ্রিকরা এই অঞ্চলকে পার্সিস (বর্তমান ইরানের ফার্স প্রদেশ) বলে ডাকত, এবং সেখান থেকে ইউরোপীয় ভাষায় এর নাম হয় পার্সিয়া , যা বাংলায় লিপ্যন্তর করা হয় পারস্য হিসেবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url