ফলো-অন কি? টেস্ট ক্রিকেটে ফলো-অনের গুরুত্ব ও প্রভাব
ক্রিকেটের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও কৌশলগত পদক্ষেপ ফলো-অন। এটি তখনই প্রয়োগ হয় যখন একটি দল প্রতিপক্ষ দলের প্রথম ইনিংসের রানের তুলনায় অনেক কম রান সংগ্রহ করে এবং সেই দলের অধিনায়ক প্রতিপক্ষকে পুনরায় ব্যাটিংয়ে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ক্রিকেটের এই কৌশলটি খেলার ধারাকে প্রভাবিত করে এবং বিশেষ করে টেস্ট ক্রিকেট-এর ক্ষেত্রে তা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
ফলো-অন এর সংজ্ঞা ও কার্যপ্রণালী
ফলো-অন (ইংরেজিতে Follow-on) ক্রিকেটে এমন একটি পরিস্থিতি, যেখানে প্রতিপক্ষ দল তাদের প্রথম ইনিংসের পরে আবার ব্যাটিং করতে বাধ্য হয়। মূলত, ফলো-অন তখনই হয় যখন দ্বিতীয় দল প্রথম দলের রানের তুলনায় ২০০ রানের কম সংগ্রহ করে (পাঁচ দিনের ম্যাচের ক্ষেত্রে)। এমন অবস্থায় প্রথম দলের অধিনায়ক ফলো-অন করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং তাদের প্রতিপক্ষকে আবারও ব্যাটিং করতে বাধ্য করে।
ক্রিকেটের আইনে ফলো-অন নিয়মিত হয় ১৩ ধারায়, যা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) দ্বারা নির্ধারিত। ফলো-অন প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে খেলার দৈর্ঘ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই প্রসঙ্গে, বিভিন্ন খেলার দৈর্ঘ্য অনুসারে রানের ব্যবধান বিভিন্ন রকম হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ:
- পাঁচ দিনের ম্যাচে: ২০০ রানের ব্যবধান প্রয়োজন।
- তিন বা চার দিনের ম্যাচে: ১৫০ রানের ব্যবধান প্রয়োজন।
- দুই দিনের ম্যাচে: ১০০ রানের ব্যবধান প্রয়োজন।
- এক দিনের ম্যাচে: ৭৫ রানের ব্যবধান প্রয়োজন।
ফলো-অন প্রয়োগের কৌশল
ফলো-অন সবসময় স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয় না; এটি অধিনায়কের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল। ফলো-অন কৌশলগত সিদ্ধান্ত হিসাবে ব্যবহৃত হয়, যেখানে দল, খেলার পরিস্থিতি, পিচের অবস্থা, আবহাওয়া এবং অবশিষ্ট সময় বিবেচনায় আনা হয়। আদর্শভাবে, ফলো-অন প্রয়োগ করা হয় যখন প্রতিপক্ষ দল ক্লান্ত বা মনোবলহীন হয় এবং প্রতিপক্ষের ব্যাটিং দুর্বল বলে মনে করা হয়।
মাইক ব্রিয়ারলি তার ‘দি আর্ট অব ক্যাপ্টেন্সি’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ফলো-অন করার প্রধান সুবিধা হলো সময় সঞ্চয় করা। যদি প্রথম দল প্রতিপক্ষকে দ্বিতীয়বার আউট করতে সক্ষম হয়, তবে খেলা দ্রুত শেষ করা সম্ভব হয়, যা জয়ের জন্য সহায়ক। তাছাড়া, প্রতিপক্ষের মনোবল ভেঙে দেওয়া ও খেলায় পিছিয়ে পড়া দলকে কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলে দেওয়া একটি প্রধান কৌশল।
ফলো-অন এর সুবিধা
ফলো-অন করার ফলে দলটি তাদের প্রতিপক্ষকে তাড়াতাড়ি ব্যাটিংয়ে নামিয়ে সময়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসে। এটি খেলার গতিকে দ্রুত করে দেয় এবং জয়ের সম্ভাবনা বাড়ায়। ফলো-অন প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে মূল সুবিধাগুলো নিম্নরূপ:
- সময়ের নিয়ন্ত্রণ: ফলো-অন করার ফলে প্রতিপক্ষকে দ্বিতীয়বার ব্যাটিংয়ে পাঠানো হয়, যা সময়ের সঞ্চয় করে এবং প্রতিপক্ষকে চাপে রাখে।
- দ্বিতীয় ইনিংসে দুর্বল ব্যাটিং: অনেক সময় ফলো-অনে পাঠানো দল দ্বিতীয় ইনিংসে ভালো ব্যাট করতে ব্যর্থ হয়, যার ফলে জয়ের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
- মনোবল ভেঙে দেওয়া: প্রতিপক্ষ দল ফলো-অন করার পর মনোবল হারায়, যা তাদের পারফরম্যান্সে প্রভাব ফেলে।
- পিচের সুবিধা: দ্বিতীয় ইনিংসে খেলার শেষদিককার পিচ অনেক সময় বোলারদের জন্য সহায়ক হয়, যা ফলো-অন করা দলের বোলারদের জন্য সুবিধাজনক।
ফলো-অন না করার কারণ
তবে, ফলো-অন করার সিদ্ধান্ত সবসময় উপকারী নাও হতে পারে। অনেক সময় দল ফলো-অন না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর পেছনে কয়েকটি কারণ থাকতে পারে, যেমন:
- বোলারদের ক্লান্তি: ফলো-অন করার ক্ষেত্রে বোলারদের ক্লান্তি একটি বড় কারণ হতে পারে। প্রথম ইনিংসে দীর্ঘ সময় ধরে বল করার পর, বোলারদের ক্লান্তি তাদের কার্যকারিতা হ্রাস করে।
- রান সংগ্রহের কৌশল: ফলো-অন না করার মাধ্যমে দলটি আবার ব্যাটিংয়ে নেমে বড় রান সংগ্রহ করে প্রতিপক্ষের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এই কৌশলটি প্রয়োগ করলে, প্রতিপক্ষের দলকে রান চেজ করার জন্য পর্যাপ্ত সময় দেয়া হয় না।
- পিচের পরিবর্তন: খেলার শেষদিকে পিচ অনেক সময় ভিন্নতর হয়ে যায়, যা ফলো-অন না করলে দলের পক্ষে হতে পারে। বিশেষ করে স্পিন বোলারদের জন্য শেষদিককার পিচ অত্যন্ত সহায়ক হয়।
বিখ্যাত ম্যাচে ফলো-অন এর প্রয়োগ
ফলো-অন কৌশলটি ক্রিকেটের ইতিহাসে অনেক বিখ্যাত ম্যাচে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। নিম্নলিখিত কয়েকটি বিখ্যাত উদাহরণ আলোচনা করা হলো:
১৯৮১ সালের বোথামের টেস্ট (ইংল্যান্ড বনাম অস্ট্রেলিয়া, হেডিংলি): ইয়ান বোথাম অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখিয়ে ফলো-অন পরবর্তী ম্যাচে ইংল্যান্ডকে জয় এনে দেন। ফলো-অনের পরে অসাধারণ বোলিং এবং ব্যাটিংয়ের মাধ্যমে ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়াকে হারায়।
২০০১ সালের ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া, ইডেন গার্ডেন্স: ভারতীয় ব্যাটসম্যান ভি. ভি. এস. লক্ষ্মণ এবং রাহুল দ্রাবিড়ের অসাধারণ পারফরম্যান্সের জন্য এই ম্যাচটি বিখ্যাত। ফলো-অন পরেও ভারত দ্বিতীয় ইনিংসে ৬৫৭ রান তুলে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেয়।
১৮৯৪-৯৫ অ্যাশেজ সিরিজ: সিডনিতে অনুষ্ঠিত এই ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া বড় রানের ব্যবধানে এগিয়ে থাকার পরেও, ইংল্যান্ড ফলো-অন করে ম্যাচটি জিতে নেয়। এটি অ্যাশেজ সিরিজের একটি স্মরণীয় মুহূর্ত ছিল।
ফলো-অন কৌশল: বর্তমান প্রেক্ষাপট
বর্তমানে টেস্ট ক্রিকেটে ফলো-অন কৌশলটির ব্যবহার কম হতে দেখা যায়। অনেক অধিনায়ক ফলো-অন করার পরিবর্তে দ্বিতীয়বার ব্যাটিংয়ে নামেন, যা প্রতিপক্ষের উপর আরও চাপ সৃষ্টি করতে সহায়ক। উদাহরণস্বরূপ, অ্যান্ড্রু স্ট্রস এবং রিকি পন্টিং অনেক সময় ফলো-অন না করে তাদের দলকে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে পাঠিয়েছেন এবং সফলতাও পেয়েছেন। এই কৌশলটি প্রতিপক্ষকে চাপে রাখার একটি কার্যকর উপায় হতে পারে, বিশেষ করে খেলার শেষদিকে পিচ যখন বোলারদের পক্ষে থাকে।
অধিনায়করা ফলো-অন না করার মূল কারণ হলো বোলারদের বিশ্রামের প্রয়োজন, কারণ ধারাবাহিকভাবে বোলিং করলে বোলাররা ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তাছাড়া, দ্বিতীয়বার ব্যাটিং করে প্রতিপক্ষকে বড় লক্ষ্য দেওয়ার মাধ্যমে তাদের মানসিকভাবে চাপে রাখা সম্ভব হয়।
ফলো-অন এর প্রভাবিত ম্যাচ ও শিক্ষা
ফলো-অন এর প্রয়োগ ও এর ফলাফল ক্রিকেটের ইতিহাসে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ম্যাচে দেখা গেছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৫০ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম অস্ট্রেলিয়া টেস্ট ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক ফলো-অন না করায়, অস্ট্রেলিয়া পরে ঐতিহাসিক জয় পায়। একইভাবে, ২০১০ সালের আফগানিস্তান বনাম কানাডা ম্যাচে কানাডা ফলো-অন না করায় আফগানিস্তান একটি দারুণ জয় পায়।
এ ধরনের ম্যাচগুলো ফলো-অন কৌশলের সম্ভাব্য বিপর্যয় এবং এর কৌশলগত গুরুত্বকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। এ থেকে শিক্ষা নেওয়া যায় যে, ফলো-অন প্রয়োগ করার আগে অধিনায়ককে দলের শক্তি, বোলারদের ক্লান্তি, পিচের অবস্থা এবং প্রতিপক্ষের দুর্বলতা বিবেচনা করতে হয়।
উপসংহার
ফলো-অন ক্রিকেটের একটি অত্যন্ত কৌশলগত পদক্ষেপ, যা খেলায় জয়ের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদিও ফলো-অন কৌশলটি সব সময় উপকারী নাও হতে পারে, তবে সঠিক পরিস্থিতিতে এটি প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলার এবং খেলার গতিধারা পরিবর্তন করার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। ফলো-অন প্রয়োগের সঠিক কৌশল ক্রিকেটের ইতিহাসে অনেক বিখ্যাত ম্যাচের ফলাফল নির্ধারণ করেছে, এবং এর সঠিক ব্যবহারে জয়ের সম্ভাবনা অনেকগুণ বেড়ে যায়।
Source :
1. https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AB%E0%A6%B2%E0%A7%8B-%E0%A6%85%E0%A6%A8