ফারাক্কা বাঁধের অবস্থান ও বাংলাদেশের উপর এর প্রভাব

ফারাক্কা বাঁধের অবস্থান ও বাংলাদেশের উপর এর প্রভাব


ফারাক্কা বাঁধ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় অবস্থিত, যা গঙ্গা নদীর উপর নির্মিত একটি অন্যতম প্রধান বাঁধ। বাঁধটি প্রথমত কলকাতা বন্দরের পলি সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে নির্মিত হলেও, এর প্রভাব বাংলাদেশসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়ার পানি ব্যবস্থার ওপর পড়েছে। এই নিবন্ধে আমরা ফারাক্কা বাঁধের ইতিহাস, বাঁধের কার্যকারিতা, এবং বাংলাদেশের উপর এর প্রভাব বিশদভাবে আলোচনা করব। একইসঙ্গে ফারাক্কা বাঁধের অবস্থান এবং এর গেট সংখ্যা নিয়েও বিশদ আলোচনা করা হবে। মূলত ফারাক্কা বাঁধ কোথায় অবস্থিত, এর প্রয়োজনীয়তা, এবং এর ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন প্রভাব নিয়ে এখানে আলোচনা করা হবে।

ফারাক্কা বাঁধের ইতিহাস এবং নির্মাণ

ফারাক্কা বাঁধের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৬১ সালে, যা সম্পন্ন হয় ১৯৭৫ সালে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতায় এই বিশাল প্রকল্পটি সম্পন্ন হয়, যা প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিত হয়। বাঁধটির দৈর্ঘ্য ২,২৪০ মিটার (৭,৩৫০ ফুট) এবং এতে মোট ১০৯টি গেট রয়েছে। ফারাক্কা বাঁধ কোন নদীর উপর অবস্থিত? গঙ্গা নদীর উপর অবস্থিত এই বাঁধটি ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বাঁধের মূল উদ্দেশ্য ছিল কলকাতা বন্দরের পলি জমা সমস্যা সমাধান করা। গঙ্গা নদীর জল প্রবাহের কিছু অংশ হুগলি নদীতে চালিত করে, নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কলকাতা বন্দরকে কার্যকর রাখা যায়। ফারাক্কা বাঁধের পানি প্রধানত হুগলি নদীর দিকে প্রবাহিত হয়, যা শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানির স্তর হ্রাস করে।

ফারাক্কা বাঁধের অবস্থান এবং ভূমিকা

ফারাক্কা বাঁধ কোথায় অবস্থিত? এটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় অবস্থিত। বাঁধটি বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশের কোন জেলায় অবস্থিত? যদিও বাঁধটি সরাসরি বাংলাদেশের কোনো জেলায় অবস্থিত নয়, তবে এর প্রভাব বাংলাদেশের রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া এবং অন্যান্য সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে স্পষ্টভাবে প্রভাবিত হয়।

ফারাক্কা বাঁধের উদ্দেশ্য এবং কার্যকারিতা

ফারাক্কা বাঁধের কাজ কী? এর মূল কাজ হল গঙ্গা নদীর পানি নিয়ন্ত্রণ করে হুগলি নদীতে প্রবাহিত করা, যাতে কলকাতা বন্দরের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। বাঁধের মাধ্যমে হুগলি নদীতে পর্যাপ্ত পানি প্রবাহ নিশ্চিত করা হয়, যা পলি জমা রোধ করে এবং নাব্যতা বৃদ্ধি করে। এছাড়াও, বাঁধের মাধ্যমে সরবরাহকৃত পানি ফারাক্কা সুপার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র সহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়।

ফারাক্কা বাঁধের ইতিবাচক প্রভাব

ফারাক্কা বাঁধের কিছু ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে, যা প্রধানত ভারতের জন্য উপকারী। কলকাতা বন্দরের পলি সমস্যা সমাধান এবং হুগলি নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি করে এটি ভারতের অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে সচল রাখতে সাহায্য করেছে। এছাড়াও, বাঁধের মাধ্যমে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানেও পানি সরবরাহ করা হয়, যা ভারতের বিদ্যুৎ উৎপাদনে সহায়ক হয়েছে।

ফারাক্কা বাঁধের নেতিবাচক প্রভাব

ফারাক্কা বাঁধের নেতিবাচক প্রভাব প্রধানত বাংলাদেশে অনুভূত হয়েছে। বাঁধটি নির্মাণের ফলে গঙ্গা নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়েছে, যার কারণে বাংলাদেশের নদীগুলিতে পানির স্তর উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে পদ্মা নদীতে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের কৃষি, মৎস্য এবং পানি সরবরাহ ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

ফারাক্কা বাঁধের গেট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত পানির প্রবাহের ফলে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষত রাজশাহী, কুষ্টিয়া, এবং চাপাইনবাবগঞ্জ জেলাগুলোতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস পেয়েছে, যা কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহে সমস্যার সৃষ্টি করেছে।

বাংলাদেশের ক্ষতি এবং ফারাক্কা বাঁধের প্রভাব

ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি এবং পরিবেশের উপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের নদীগুলিতে পানির স্তর এতটাই কমে যায় যে কৃষিকাজ বাধাগ্রস্ত হয়। পদ্মা নদীর পানি প্রবাহ হ্রাস পাওয়ার কারণে মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা খুলনা অঞ্চলের জমির উর্বরা শক্তি কমিয়ে দিয়েছে।

ফারাক্কা বাঁধের প্রভাব সম্পর্কে বলতে গেলে, এটি বাংলাদেশের নৌ-পরিবহন ব্যবস্থাতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। পদ্মা নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় অনেক নৌপথ নৌচলাচলের জন্য অযোগ্য হয়ে পড়েছে, যা বাংলাদেশে পরিবহন খরচ বৃদ্ধি করেছে এবং অনেক মানুষকে কর্মহীন করেছে।

ফারাক্কা লং মার্চ এবং বাংলাদেশের প্রতিবাদ

ফারাক্কা বাঁধের প্রভাব নিয়ে বাংলাদেশের মধ্যে অসন্তোষ এবং প্রতিবাদ দেখা গেছে, যার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হল ফারাক্কা লং মার্চ। ১৯৭৬ সালে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে এই লং মার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যা বাংলাদেশের পানির অধিকার রক্ষার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবাদ ছিল।

লং মার্চের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ ফারাক্কা বাঁধের কারণে সৃষ্ট সমস্যাগুলির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন এবং আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই লং মার্চের পর থেকেই ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে আলোচনার ভিত্তি তৈরি হয়, এবং এর পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

ফারাক্কা বাঁধের পানি বণ্টন চুক্তি

ফারাক্কা বাঁধের পানির বণ্টন নিয়ে ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে অনেক আলোচনা এবং চুক্তি হয়েছে। ১৯৭৭ সালে প্রথম পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা পাঁচ বছরের জন্য কার্যকর ছিল। পরবর্তীতে ১৯৮২, ১৯৮৫, এবং ১৯৯৬ সালে নতুন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেব গৌড়া গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি সই করেন, যা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নত করতে সহায়ক হয়েছিল। তবে, দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের অভাবে এই সমস্যার সমাধান আজও সম্পূর্ণ হয়নি।

উপসংহার

ফারাক্কা বাঁধ যেমন ভারতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প, তেমনি বাংলাদেশের জন্যও এটি একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়। ফারাক্কা বাঁধের ইতিহাস, এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব, এবং ফারাক্কা লং মার্চ নিয়ে বিশদ আলোচনা প্রমাণ করে যে এই বাঁধের প্রভাব বাংলাদেশের জন্য আজও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এই প্রভাবগুলোর সমাধান করতে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। ভবিষ্যতে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব হলে, উভয় দেশের মানুষ উপকৃত হবে এবং সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url