টেলিগ্রাম মেসেজিং অ্যাপ: বৈশিষ্ট্য, সুবিধা ও ব্যবহারিক টিপস
ইন্টারনেট-নির্ভর মেসেজিং অ্যাপগুলোর মধ্যে বর্তমানে অন্যতম জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত একটি নাম হলো টেলিগ্রাম অ্যাপ। বর্তমানে সুরক্ষিত বার্তা আদান-প্রদান এবং বিস্তারিত গোপনীয়তা রক্ষার কারণে এটি অনেকের পছন্দের মেসেজিং মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুক মেসেঞ্জার এবং হোয়াটসঅ্যাপ এর মতো বড় মেসেজিং অ্যাপগুলোর জনপ্রিয়তা থাকলেও, টেলিগ্রাম এর বর্ধিত গোপনীয়তা, এনক্রিপশন, এবং বড় গ্রুপ চ্যাট সুবিধা মানুষকে এই অ্যাপের দিকে আকৃষ্ট করেছে। আসুন, টেলিগ্রামের ইতিহাস, বৈশিষ্ট্য এবং সুবিধাসমূহ বিস্তারিতভাবে জানার চেষ্টা করি।
টেলিগ্রাম কি?
টেলিগ্রাম হলো একটি ক্লাউড-ভিত্তিক মেসেজিং অ্যাপ, যা ফেসবুক মেসেঞ্জার এবং হোয়াটসঅ্যাপের মতোই কাজ করে। মোবাইল ডেটা, হটস্পট, বা ওয়াই-ফাই ব্যবহার করে আপনি এই অ্যাপটির মাধ্যমে বার্তা প্রেরণ করতে পারেন। তবে, প্রাপকের ও আপনার উভয়েরই টেলিগ্রাম প্রোফাইল থাকতে হবে।
টেলিগ্রামের দাবি হলো, এটি নিরাপত্তা এবং হাই-স্পিড মেসেজিং পারফর্মান্স প্রদান করতে সক্ষম। এনক্রিপশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই অ্যাপটি ব্যবহারকারীর তথ্য সুরক্ষিত রাখে এবং দ্রুততার সাথে বার্তা পৌঁছে দেয়।
টেলিগ্রামের ইতিহাস
টেলিগ্রাম প্রথমে ২০১৩ সালে চালু করা হয়। নিকোলাই এবং পাভেল দূরভ নামে দুই ভাই এই অ্যাপটির প্রতিষ্ঠাতা। নিকোলাই এই অ্যাপের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং পাভেল আর্থিক ও আদর্শিক সমর্থন দিয়ে থাকেন। নিকোলাই এর কাস্টম ডেটা প্রোটোকল এর মাধ্যমে টেলিগ্রাম একটি বহু-ডেটা-সেন্টার ভিত্তিক অ্যাপ হিসেবে গড়ে ওঠে, যা সুরক্ষা এবং দ্রুততার জন্য প্রসিদ্ধ।
২০১৭ সালে, টেলিগ্রামের সিইও পাভেল দূরভ কোম্পানিটি রাশিয়া থেকে আরবে স্থানান্তরিত করেন এবং ২০২১ সালে ফরাসি নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। বর্তমানে, সারা বিশ্বে ৯০০ মিলিয়ন এরও বেশি মানুষ সক্রিয়ভাবে টেলিগ্রাম ব্যবহার করছেন।
টেলিগ্রামের মুখ্য বৈশিষ্ট্য
টেলিগ্রাম অ্যাপটির বেশ কয়েকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা একে অন্যান্য মেসেজিং অ্যাপের থেকে আলাদা করে তোলে। এই বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
বিনামূল্য অ্যাপ: টেলিগ্রাম সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত। এর কোনো সাবস্ক্রিপশন ফি বা বিজ্ঞাপন নেই, যা ব্যবহারকারীদের জন্য আকর্ষণীয়।
একাধিক ডিভাইসে ব্যবহারের সুবিধা: একই অ্যাকাউন্ট আপনি ফোন, কম্পিউটার, বা ট্যাবলেট সহ বিভিন্ন ডিভাইসে ব্যবহার করতে পারবেন, এবং বার্তাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিঙ্ক হয়ে যাবে।
বর্ধিত এনক্রিপশন এবং গোপনীয়তা: ক্লায়েন্ট-টু-সার্ভার এনক্রিপশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে, এটি বার্তাগুলো সুরক্ষিত রাখে। গোপন চ্যাট বার্তাগুলোর ক্ষেত্রে এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন ব্যবহার করা হয়।
গ্রুপ চ্যাট এবং সেলফ-ডেস্ট্রাকটিং মেসেজিং: টেলিগ্রামে বড় গ্রুপ চ্যাট সুবিধা রয়েছে, যা একসাথে হাজার হাজার মানুষকে সংযুক্ত করতে পারে। এছাড়াও, সেলফ-ডেস্ট্রাকটিং মেসেজিং বৈশিষ্ট্যটির মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময় পর বার্তাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুছে যায়।
কম জায়গা নেয়া: আপনার ডিভাইসে এটি মাত্র ১০০ MB এর কম স্টোরেজ জায়গা নেয়, যার ফলে ফোন মেমরি কম থাকলেও ক্লাউড স্টোরেজ ব্যবহারের মাধ্যমে মিডিয়া ফাইল সংরক্ষণ করতে পারবেন।
বিনামূল্যে পরিষেবা: টেলিগ্রাম চিরকাল বিনামূল্যে ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত থাকবে এবং এর মাধ্যমে কোনো সাবস্ক্রিপশন ফি কিংবা বিজ্ঞাপন গ্রহণ করা হবে না।
টেলিগ্রামের সুবিধা
টেলিগ্রাম অ্যাপটি অন্যান্য মেসেজিং অ্যাপগুলোর তুলনায় বেশ কিছু বিশেষ সুবিধা প্রদান করে থাকে, যেমন:
বড় গ্রুপ চ্যাট: যেখানে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ মাত্র ২৫৬ জন সদস্যকে সমর্থন করে, সেখানে টেলিগ্রামে একসাথে ২,০০,০০০ জন মানুষের বড় গ্রুপ তৈরি করা যায়।
সেলফ-ডেস্ট্রয়িং মেসেজ: গোপন চ্যাট এবং সেলফ-ডেস্ট্রয়িং মেসেজ সুবিধার মাধ্যমে আপনার বার্তাগুলো নির্দিষ্ট সময় পরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুছে যায়।
মাল্টি-প্ল্যাটফর্ম সমর্থন: অ্যান্ড্রয়েড, আইওএস, উইন্ডোজ, লিনাক্স, এবং ম্যাক এর মতো সব প্ল্যাটফর্মে টেলিগ্রাম উপলব্ধ। ওয়েব ব্রাউজার থেকেও ব্যবহার করা যায়।
বিনামূল্যে সার্ভিস: টেলিগ্রাম সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পরিষেবা প্রদান করে, যেখানে কিছু দেশে হোয়াটসঅ্যাপ বার্ষিক ফি চার্জ করে থাকে।
বড় ফাইল ট্রান্সফার: টেলিগ্রাম ১.৫ GB সাইজ পর্যন্ত ফাইল ট্রান্সফার করতে সক্ষম, যেখানে হোয়াটসঅ্যাপ মাত্র ১৬ MB পর্যন্ত ফাইল সাপোর্ট করে।
ক্লাউড স্টোরেজ: টেলিগ্রামে আপনার পাঠানো ও গ্রহণ করা সমস্ত ফাইল ও তথ্য ক্লাউড স্টোরেজে সেভ হয়, ফলে আপনার মোবাইল মেমোরি প্রভাবিত হয় না।
ওপেন সোর্স এবং নিয়মিত আপডেট: টেলিগ্রাম একটি ওপেন সোর্স অ্যাপ। ডেভেলপাররা স্বাধীনভাবে এটি উন্নত করে, নতুন ফাংশন ও বৈশিষ্ট্য যুক্ত করতে পারেন, ফলে এটি প্রতিনিয়ত আপডেট হয়।
টেলিগ্রাম চ্যানেল কি?
টেলিগ্রাম চ্যানেল হলো একটি প্রচার মাধ্যম, যার মাধ্যমে অসংখ্য দর্শকদের কাছে আপনার বার্তা সম্প্রচার করতে পারবেন। টেলিগ্রাম চ্যানেলে সীমাহীন গ্রাহক যুক্ত করা সম্ভব এবং শুধুমাত্র অ্যাডমিন এরাই পোস্ট করতে পারেন। এটি বিশেষত ব্যবসায়িক এবং বিপণনমূলক কাজের জন্য অত্যন্ত কার্যকর।
কিভাবে টেলিগ্রাম ব্যবহার করবেন?
টেলিগ্রাম ব্যবহার করা অত্যন্ত সহজ। প্রথমে গুগলের প্লে স্টোর অথবা অ্যাপলের অ্যাপ স্টোর থেকে অ্যাপটি ডাউনলোড করুন। ইনস্টল করার পর, আপনার ফোন নম্বর দিয়ে প্রোফাইল তৈরি করুন। এরপর আপনার বন্ধুদের সাথে সংযোগ করতে পারবেন এবং অডিও বা ভিডিও কল করার সুযোগও পাবেন।
টেলিগ্রামের কিছু বিশেষ ট্রিকস
গোপন চ্যাট ব্যবহার করুন, যা এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন দ্বারা সুরক্ষিত এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডিলিট হয়ে যায়।
কাস্টম স্টিকার প্যাক তৈরি করে আপনার চ্যাটিংকে আরো মজাদার করে তুলুন।
সেভড মেসেজেস ফিচার ব্যবহার করে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা এবং নোট সংরক্ষণ করুন।
টেলিগ্রাম বট ব্যবহার করে বিভিন্ন কাজের সুবিধা পান, যেমন রিমাইন্ডার সেট করা, নিউজ আপডেট পাওয়া ইত্যাদি।
অ্যাপ লক ফিচার ব্যবহার করে আপনার অ্যাপটিকে আরো সুরক্ষিত করুন।
শেষ কথা
টেলিগ্রাম অ্যাপ বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম সেরা মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পরিচিত। সুরক্ষা, গোপনীয়তা, এবং ব্যবহারিক সুবিধা সহ এটি একটি আদর্শ মেসেজিং অ্যাপ। আশা করি, টেলিগ্রাম সম্পর্কে এই বিশদ তথ্য আপনার জন্য উপকারী হবে এবং আপনি এটি ব্যবহারের জন্য আগ্রহী হবেন। টেলিগ্রামের সব সুবিধা উপভোগ করতে, আপনি অবশ্যই এটি ইনস্টল করে ব্যবহার করতে পারেন।