বাবরি মসজিদ: ইতিহাস, ধ্বংসের কারণ এবং প্রভাব

বাবরি মসজিদ: ইতিহাস, ধ্বংসের কারণ এবং প্রভাব


বাবরি মসজিদ ভারতের উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যায় অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা, যা ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল। এটি ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম বিতর্কিত ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিষয়গুলোর মধ্যে একটি। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর এই মসজিদটি ধ্বংস করা হয়, যা ভারতের সাম্প্রদায়িক ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হয়ে রয়েছে। এই ঘটনার পটভূমি, কারণ এবং প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার আগে, বাবরি মসজিদের ইতিহাস সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।


বাবরি মসজিদের ইতিহাস

বাবরি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন মুঘল সেনাপতি মির বাকি। মসজিদটি ১৫২৮ সালে মুঘল সম্রাট বাবরের নামানুসারে নির্মিত হয় এবং এটি দীর্ঘকাল ধরে স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের উপাসনার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে, হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি অংশ দাবি করে যে, মসজিদটি রামের জন্মস্থান "রাম জন্মভূমি"র উপরে নির্মাণ করা হয়েছিল। তাদের মতে, মসজিদ নির্মাণের জন্য একটি প্রাচীন রাম মন্দির ধ্বংস করা হয়েছিল।

রাম জন্মভূমি বিতর্ক

অযোধ্যা হিন্দুদের কাছে একটি পবিত্র স্থান হিসেবে পরিচিত, কারণ এটি হিন্দু দেবতা রামের জন্মস্থান হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু বাবরি মসজিদের স্থাপনা ও নির্মাণের পেছনে ঐতিহাসিক প্রমাণ বিতর্কিত। কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে মসজিদের নিচে একটি কাঠামো পাওয়া গেছে, যা হিন্দু মন্দিরের অংশ বলে দাবি করা হয়। তবে এ বিষয়ে ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে মতভেদ রয়েছে।


বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কারণ

১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) এবং ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) মসজিদটির স্থানটিকে রাম মন্দির হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচারণা চালায়। এই প্রচারণায় রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উদ্দেশ্য উভয়ই নিহিত ছিল। রাম রথ যাত্রা, যার নেতৃত্ব দেন বিজেপি নেতা লাল কৃষ্ণ আদভানি, হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থানে বড় ভূমিকা রাখে।

১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর: ধ্বংসযজ্ঞের দিন

১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর, ভিএইচপি এবং বিজেপির আহ্বানে প্রায় দেড় লাখ করসেবক (ধর্মীয় কর্মী) অযোধ্যায় জমায়েত হয়। উন্মত্ত জনতা কুঠার, হাতুড়ি এবং গাইতি দিয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে। এই ঘটনাটি ভারতের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়।


বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরবর্তী প্রভাব

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা সারা ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্ম দেয়। হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে কয়েক মাস ধরে সংঘর্ষ চলে, যেখানে প্রায় ২,০০০ জন মানুষ প্রাণ হারায়। এর প্রভাব সীমাবদ্ধ ছিল না, এটি পাকিস্তান, বাংলাদেশ, এবং যুক্তরাজ্য সহ অন্যান্য দেশেও উত্তেজনার সৃষ্টি করে।

ভারতের অভ্যন্তরীণ প্রভাব

  • মুম্বাই দাঙ্গা: বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিক্রিয়ায় মুম্বাইতে বড় ধরনের দাঙ্গা হয়, যেখানে প্রায় ৯০০ জন নিহত হন।
  • সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম বৃদ্ধি: ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনসহ বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বাবরি মসজিদ ধ্বংসকে তাদের কার্যক্রমের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। পাকিস্তানে ৩০টিরও বেশি হিন্দু মন্দির ধ্বংস করা হয়। বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও মন্দিরে আক্রমণ করা হয়, এবং দুর্গাপূজার উৎসব জাঁকজমকভাবে উদযাপন বন্ধ হয়ে যায়।


বাবরি মসজিদ মামলা এবং বিচার

বাবরি মসজিদ ধ্বংস নিয়ে বহু আইনি লড়াই হয়েছে। ১৯৯২ সালে মসজিদ ধ্বংসের পর দুইটি এফআইআর দায়ের হয়েছিল। লিবারহান কমিশন ২০০৯ সালে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করে, যেখানে ৬৮ জন ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এর মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন বিজেপি এবং ভিএইচপির নেতা।

২০১৯ সালের সুপ্রিম কোর্টের রায়

২০১৯ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বাবরি মসজিদের জমি রাম মন্দির নির্মাণের জন্য প্রদান করে। এটি একটি বিতর্কিত রায় ছিল, যা হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। আদালত নির্দেশ দেয় যে, মুসলমানদের জন্য অযোধ্যায় একটি বিকল্প জমি বরাদ্দ করতে হবে।


বাবরি মসজিদের রাজনৈতিক প্রভাব

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা বিজেপির রাজনৈতিক উত্থানে বড় ভূমিকা রাখে। এই ঘটনাকে ঘিরে হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শক্তিশালী হয় এবং বিজেপি ভারতের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। অন্যদিকে, কংগ্রেস এবং অন্যান্য দলগুলো তাদের জনপ্রিয়তা হারায়।


বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিক্রিয়ায় জনপ্রিয় সংস্কৃতি

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা বিভিন্ন চলচ্চিত্র, উপন্যাস এবং প্রামাণ্যচিত্রে তুলে ধরা হয়েছে।

  • আনন্দ পটবর্ধনের প্রামাণ্যচিত্র "রাম কে নাম" এই বিষয়ে বিশেষভাবে আলোকপাত করেছে।
  • বোম্বে (১৯৯৫) এবং ব্ল্যাক ফ্রাইডে (২০০৭) চলচ্চিত্রগুলোতে এই ঘটনার প্রভাব দেখানো হয়েছে।
  • মালয়ালম সাহিত্যিক এন. এস. মাধবনের গল্প "থিরুথু" এবং অন্তরা গাঙ্গুলির উপন্যাস "তানিয়া তানিয়া" এই ঘটনার পটভূমি নিয়ে রচিত হয়েছে।

উপসংহার

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা শুধু ভারতের ইতিহাস নয়, বিশ্ব রাজনীতিতেও একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে রয়েছে। এটি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিভাজনের একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। বাবরি মসজিদ, রাম জন্মভূমি বিতর্ক, এবং এর প্রভাব ভবিষ্যতেও গবেষণা ও আলোচনার বিষয় হয়ে থাকবে।

এই ঘটনা ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রয়োজনীয়তা স্মরণ করিয়ে দেয়। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়ানোর জন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সাধারণ নাগরিকদের একযোগে কাজ করতে হবে।

বাবরি মসজিদের ইতিহাস, ধ্বংসের কারণ, এবং এর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে আলোচনা আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষণীয়। এটি একটি উদাহরণ যে কিভাবে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিষয়গুলোর অপব্যবহার সমাজকে বিভক্ত করতে পারে।


বাবরি মসজিদ কে ধ্বংস করেন?

১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভিএইচপি ও বিজেপি ঐ স্থানে দেড় লাখ করসেবককে নিয়ে একটি শোভাযাত্রা বের করে। শোভাযাত্রা চলাকালে তারা সহিংস হয়ে পড়ে এবং আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাধা উপেক্ষা করে মসজিদটি ভেঙে ফেলে।

বাবরি মসজিদ কত সালে নির্মিত হয়?

বাবরি মসজিদ , অযোধ্যায় মসজিদ , উত্তর প্রদেশ , ভারত । সাইটের শিলালিপি অনুসারে, এটি ইসলামিক ক্যালেন্ডারের (সেপ্টেম্বর 1528-সেপ্টেম্বর 1529 CE ) 935 সালে নির্মিত হয়েছিল। মীর বাকি, সম্ভবত মুঘলসম্রাট বাবরের অধীনে কাজ করতেন।

অযোধ্যা শব্দের অর্থ কি?

অযোধ্যা নামের আক্ষরিক অর্থ সংস্কৃতে "অজেয়", যা যুধ ("লড়াই করা, যুদ্ধ করা") থেকে উদ্ভূত।

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কারণ?

1990 সালে, হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা ওই স্থানে একটি মন্দির নির্মাণের অভিপ্রায়ে মসজিদে ঝড়ের পর উত্তর ভারতে দাঙ্গা শুরু হয়; পরবর্তী সংকট ভারত সরকারের পতন ঘটায়। দুই বছর পর, 1992 সালের 6 ডিসেম্বর, হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের ভিড় কয়েক ঘন্টার মধ্যে তিনতলা মসজিদটি ভেঙে দেয়।

রায়ট কত সালে হয়েছিল?

১৯৬৪ সালের ২ জানুয়ারি তারিখে হজরতবাল ঘটনার প্রেক্ষিতে মুসলিমরা হিন্দুদেরকে পায়ে জুতো পরতে, মাথায় ছাতা ব্যবহার করতে কিংবা রিকশায় চড়তে বাধা দেয়। মধ্যাহ্নে মুসলিমরা সমগ্র খুলনাব্যাপী মিছিল বের করে এবং মিছিল থেকে হুঙ্কার আসতে থাকে, 'হিন্দুদেরকে হত্যা কর'। বিকাল চারটার দিকে খুলনায় হিন্দু নিধন শুরু হয়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url