আরাকান আর্মি কারা? তাদের উত্থান, কার্যক্রম ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
আরাকান আর্মি (Arakan Army), সংক্ষেপে এএ (AA), মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যভিত্তিক একটি গুরুত্বপূর্ণ সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন। এটি ২০০৯ সালের ১০ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ইউনাইটেড লীগ অফ আরাকান (ULA) এর সামরিক শাখা হিসেবে কাজ করছে। মূলত, আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক স্বাধিকার রক্ষার লক্ষ্যে গঠিত হয়েছিল। তবে এ সংগঠনটি নিয়ে বিতর্ক, সংঘাত এবং সমর্থনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এ নিবন্ধে আমরা বিশদভাবে আলোচনা করবো "আরাকান আর্মি কারা?", তাদের উত্থান, কার্যক্রম, সামরিক শক্তি এবং রাজনৈতিক অবস্থান।
আরাকান আর্মির উত্থান
প্রতিষ্ঠা ও উদ্দেশ্য
২০০৯ সালে কাচিন রাজ্যের লাইজাতে আরাকান আর্মির প্রতিষ্ঠা হয়। এর প্রাথমিক সদস্যসংখ্যা ছিল মাত্র ২৬ জন। কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি (KIA)-এর সহায়তায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এ সংগঠনটি গঠিত হয়। আরাকান আর্মির প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল রাখাইন জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, জাতীয় পরিচয় রক্ষা এবং আরাকানের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার করা।
আরাকান আর্মির বর্তমান কমান্ডার ইন চিফ মেজর জেনারেল তোয়ান মারত নাইং এবং ভাইস ডেপুটি কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নিয়ো টোয়ান আং। তারা এই সংগঠনকে সুসংগঠিত করে রাখাইন অঞ্চলে এর কার্যক্রম বিস্তৃত করেছেন।
আরাকান আর্মি কারা?
আরাকান আর্মি মূলত রাখাইন নৃগোষ্ঠীর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা পরিচালিত একটি বিদ্রোহী সংগঠন। রাখাইন নৃগোষ্ঠী, যাদের পূর্বে আরাকানি বলা হতো, তাদের ইতিহাস এবং সংস্কৃতিকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে এই সংগঠন গঠিত হয়। যদিও এটি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের দ্বারা পরিচালিত, তবে তাদের লক্ষ্য বহুজাতিক আরাকান জনসংখ্যার স্বার্থ রক্ষা করা।
আরাকান আর্মি কি মুসলিম?
অনেকেই প্রশ্ন করেন, "আরাকান আর্মি কি মুসলিম?" এর উত্তর হলো না। আরাকান আর্মি মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইন জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে। তবে তাদের মধ্যে মুসলিম জনগোষ্ঠীর সাথে সরাসরি বিরোধ নেই। তাদের প্রধান লক্ষ্য আরাকান রাজ্যের স্বায়ত্তশাসন এবং জাতীয় স্বার্থ রক্ষা।
আরাকান রাজ্যের ইতিহাস: স্বাধীনতা থেকে সংকট
আরাকান বা রাখাইন রাজ্য একসময় স্বাধীন ছিল। মধ্যযুগে ম্রাউক-উ রাজবংশ আরাকান শাসন করেছিল। ম্রাউক-উ রাজাদের সময়ে মুসলিম এবং বৌদ্ধদের সহাবস্থান ছিল। তাদের মুদ্রায় ফারসি ভাষায় কালেমা লেখা থাকতো। তবে ১৭৮৪ সালে বার্মিজদের আগ্রাসনে এই অঞ্চল স্বাধীনতা হারায়। এরপর থেকে রাখাইন জনগোষ্ঠী স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে আসছে।
আরাকান আর্মির সামরিক শক্তি
আরাকান আর্মি বর্তমানে মিয়ানমারের অন্যতম শক্তিশালী সশস্ত্র সংগঠন।
প্রশিক্ষণ ও সহায়তা
প্রাথমিকভাবে, তারা কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি (KIA) এর সহায়তায় প্রশিক্ষণ পায়। বর্তমানে তারা রাখাইন রাজ্যে নিজস্ব প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করেছে।সদস্যসংখ্যা
২০১৪ সালে তাদের সদস্যসংখ্যা ছিল ১,৫০০ এর বেশি। ২০২০ সালে তারা দাবি করে, তাদের সদস্য সংখ্যা ৩০,০০০-এ পৌঁছেছে।অস্ত্র ও সরঞ্জাম
উন্নত সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই গোষ্ঠী আধুনিক অস্ত্র এবং সরঞ্জাম ব্যবহার করে।
সশস্ত্র সংঘাত ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক
২০১৫ সাল থেকে আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে সশস্ত্র সংঘাত শুরু হয়। রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে।
২০২০ সালের যুদ্ধবিরতি
দুই বছরের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ২০২০ সালের নভেম্বরে আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। তবে এই যুদ্ধবিরতি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
বেসামরিক সমর্থন
রাখাইন জনগোষ্ঠীর মধ্যে আরাকান আর্মির ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। তারা দাবি করে, রাখাইন জনগণের জাতীয় মর্যাদা এবং ঐতিহ্য রক্ষার জন্য লড়াই করছে।
আরাকান আর্মির কার্যক্রম
সামরিক অভিযান
আরাকান আর্মি ২০১৫ সাল থেকে সশস্ত্র সংঘাত পরিচালনা করছে। তারা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকাতেও সক্রিয়। ২০২১ সালের একটি সংঘর্ষে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর শতাধিক সদস্য নিহত হয় বলে জানা যায়।
সামাজিক মিডিয়া প্রচারণা
তাদের কার্যক্রমে সোশ্যাল মিডিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আধুনিক ভিডিও এবং প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে তারা তরুণদের দলে আকৃষ্ট করছে।
আরাকান আর্মির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
আরাকান আর্মি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে যে তাদের লক্ষ্য "আরাকানের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার করা।" তারা বলেছে, এ বিষয়ে কোনো দরকষাকষি হবে না।
মিয়ানমারের দৃষ্টিতে আরাকান আর্মি
মিয়ানমার সরকার আরাকান আর্মিকে একটি "সন্ত্রাসী গোষ্ঠী" হিসেবে বিবেচনা করে। সরকার মনে করে, এই সংগঠন দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই সংগঠন শুধুমাত্র সামরিক শক্তি নয়, জনসমর্থনেও শক্তিশালী।
উপসংহার
আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিদ্রোহী সংগঠন। এটি মিয়ানমারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ এবং রাখাইন জনগোষ্ঠীর জন্য একটি প্রতীক। "আরাকান আর্মি কারা?", "তাদের লক্ষ্য কী?", এবং "তারা কীভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে?" – এসব প্রশ্নের উত্তর এ নিবন্ধে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
সার্বিকভাবে বলা যায়, আরাকান আর্মি শুধু সামরিক নয়, একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের প্রতীক। তাদের ভবিষ্যৎ কার্যক্রম এবং মিয়ানমারের সরকার তাদের সাথে কীভাবে সম্পর্ক বজায় রাখে, তা সময়ই বলে দেবে।
Source :