বিশ্ব ইজতেমার ময়দান ও আখেরি মোনাজাত কি ও কেন?
বিশ্ব ইজতেমা হলো বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ইসলামি সম্মেলন, যা প্রতিবছর বাংলাদেশের টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হয়। এটি মূলত তাবলিগ জামাতের বার্ষিক বৈশ্বিক সমাবেশ, যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মুসলিম একত্রিত হন। প্রতি বছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত এই ইজতেমা ধর্মীয় শিক্ষা, আমল, এবং দাওয়াতি কাজের এক বিশাল উৎসব হিসেবে পরিগণিত হয়।
বিশ্ব ইজতেমা ২০২৪ কত তারিখে?
বিশ্ব ইজতেমা ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে ও ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমদিকে দুই ধাপে অনুষ্ঠিত হবে।
- প্রথম ধাপ: ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫।
- দ্বিতীয় ধাপ: ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫।
এ বছরও এই দুই ধাপের ব্যবস্থাপনার পেছনে রয়েছে তাবলিগ জামাতের দুটি শাখা (জোবায়ের ও সাদ অনুসারী)। বিশ্ব ইজতেমার ময়দান তুরাগ নদীর তীরে প্রস্তুত করা হচ্ছে, যেখানে লাখ লাখ মানুষ একত্রিত হবেন।
বিশ্ব ইজতেমার ইতিহাস
বিশ্ব ইজতেমার উৎপত্তি এবং প্রসার এক দীর্ঘ ঐতিহাসিক পথ অতিক্রম করেছে।
১৯৪৬ সালে ঢাকার কাকরাইল মসজিদে প্রথম তাবলিগ জামাতের বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৬৬ সালে টঙ্গীর পাগার গ্রামে এই সম্মেলন স্থানান্তরিত হয়, যা ১৯৬৭ সালে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করে বিশ্ব ইজতেমা নামে।
প্রথমে এটি একটি সাধারণ আঞ্চলিক ইজতেমা ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জমায়েত হিসেবে পরিণত হয়। বর্তমানে তুরাগ নদীর তীরে ১৬০ একর এলাকায় এই বিশাল ধর্মীয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
বিশ্ব ইজতেমার ময়দান: আয়োজনের প্রস্তুতি
বিশ্ব ইজতেমার ময়দান এক বিশাল আকারের উন্মুক্ত এলাকা, যেখানে বাঁশ, চট এবং টিনের মাধ্যমে অস্থায়ী ছাউনি তৈরি করা হয়।
- দেশীয় মুসুল্লিদের জন্য: খিত্তা অনুযায়ী মাঠ ভাগ করা হয়।
- বিদেশি মেহমানদের জন্য: আলাদা টিনের ছাউনি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়।
- সুবিধা: প্রয়োজনীয় পানীয় জল, অস্থায়ী টয়লেট, চিকিৎসা সেবা এবং বিদেশিদের জন্য ভাষাগত অনুবাদের ব্যবস্থা থাকে।
বিশ্ব ইজতেমার মূল কার্যক্রম
বিশ্ব ইজতেমা এর মূল উদ্দেশ্য হলো দ্বীনের দাওয়াত প্রচার এবং মানুষের ঈমান ও আমল বৃদ্ধি।
প্রতিদিন ফজর, জোহর এবং মাগরিবের পর বয়ান (ধর্মীয় আলোচনা) অনুষ্ঠিত হয়।
বিশেষ বয়ান ও কার্যক্রম:
- ফজরের বয়ান: ঈমানের চেতনা বৃদ্ধি।
- জোহরের পর: জামাতে বের হওয়ার তাশকিল।
- মাগরিবের পর: নবী-রাসুলদের জীবন থেকে দাওয়াতি কষ্ট ও ত্যাগের শিক্ষা।
- আখেরি মোনাজাত: এটি ইজতেমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
বিশ্ব ইজতেমার মোনাজাত: আখেরি মোনাজাতের মাহাত্ম্য
বিশ্ব ইজতেমার মোনাজাত ইজতেমার চূড়ান্ত এবং সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আখেরি মোনাজাতে লাখো মুসলিম একত্রিত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা এবং কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করেন। তুরাগ নদীর তীর মুসুল্লিদের ঢলে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য ধারণ করে।
- বাংলাদেশের শীর্ষ নেতৃত্ব: রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলের নেতারাও এই মোনাজাতে অংশ নেন।
- আন্তর্জাতিক প্রার্থনা: এটি বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য শান্তি ও কল্যাণের বার্তা বহন করে।
বিশ্ব ইজতেমার দুই পর্বের আয়োজন
জনসংখ্যার বিস্তার এবং স্থান সংকটের কারণে ২০১১ সাল থেকে ইজতেমা দুই পর্বে আয়োজন করা হচ্ছে। ৩২টি জেলা এক বছরে অংশগ্রহণের সুযোগ পায় এবং বাকি ৩২ জেলা পরবর্তী বছর অংশ নেয়।
আঞ্চলিক ইজতেমা:
যেসব জেলা টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা অংশ নিতে পারে না, তাদের জন্য আঞ্চলিক ইজতেমার আয়োজন করা হয়।
বিশ্ব ইজতেমা ২০২৪ কত মানুষের সমাগম হবে?
প্রতি বছর বিশ্ব ইজতেমা প্রায় ২৫-৩০ লক্ষাধিক মানুষ অংশ নেন।
- বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ আসেন।
- বিদেশি মেহমান: প্রায় ১০০টি দেশ থেকে প্রায় ৪০০০ মুসুল্লি অংশ নেবেন।
বিশ্ব ইজতেমার বিশেষ বৈশিষ্ট্য
- দ্বীনের দাওয়াত: সাধারণ মানুষকে দাওয়াতি কাজে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা হয়।
- ঈমানি পরিবেশ: নিরবচ্ছিন্ন ধর্মীয় আলোচনার মাধ্যমে ঈমান মজবুত করার সুযোগ।
- আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণ: এটি ধর্মীয় ভ্রাতৃত্বের প্রতীক।
- বহুভাষিক বয়ান: বয়ান উর্দুতে হলেও স্থানীয় ভাষায় অনুবাদ করা হয়।
বিশ্ব ইজতেমার প্রভাব
সমাজে প্রভাব:
- মানুষের মধ্যে ধর্মীয় অনুশীলনের প্রতি আকর্ষণ বাড়ায়।
- ইসলামী দাওয়াতের প্রসার।
- সামাজিক শৃঙ্খলা এবং ঐক্য।
আন্তর্জাতিক প্রভাব:
- বিশ্ব ইজতেমার মোনাজাত পুরো বিশ্বের মুসলিমদের জন্য শান্তি এবং কল্যাণ কামনার বার্তা বহন করে।
- তাবলিগ জামাতের মাধ্যমে ইসলামের সার্বজনীন বার্তা প্রচার।
বিশ্ব ইজতেমা এর সার্বিক সুবিধা
প্রতিবছর ইজতেমায় অংশগ্রহণকারীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা হয়।
- বাংলাদেশ রেলওয়ে: অতিরিক্ত ট্রেন সার্ভিস।
- বিআরটিসি: বাস সার্ভিস বাড়ানো।
- নিরাপত্তা: সশস্ত্র বাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবক দ্বারা সুরক্ষার ব্যবস্থা।
বিশ্ব ইজতেমা ও তাবলিগের গুরুত্ব
তাবলিগ জামাতের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ইসলামের প্রচার ও প্রসার।
- নবী করিম (সা.) বলেছেন, “আমার পক্ষ থেকে একটি বাণী হলেও তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও।’’
- ইজতেমা এই দাওয়াতি কাজের সবচেয়ে বড় মাধ্যম।
উপসংহার
বিশ্ব ইজতেমা শুধু একটি ধর্মীয় সমাবেশ নয়, এটি বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক। বিশ্ব ইজতেমার ময়দান প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশে মুখরিত হয়।
আখেরি মোনাজাত এর মাধ্যমে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য শান্তি ও কল্যাণ কামনা করা হয়। ইসলামের দাওয়াত প্রচারের জন্য এটি এক অনন্য মাধ্যম। বিশ্ব ইজতেমা ২০২৪ কত তারিখে শুরু হবে, তা জেনে পরিকল্পনা করুন এবং আপনার ঈমানি পরিবেশ উপভোগ করতে প্রস্তুত হন।
Reference :