পলাশীর যুদ্ধ কত সালে হয়? কারণ, ফলাফল এবং ইতিহাস
পলাশীর যুদ্ধ উপমহাদেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, যা ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনা করে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন দিনটিতে সংঘটিত হওয়া এই যুদ্ধ বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি-এর মধ্যে সংঘটিত হয়। ইতিহাসে এই যুদ্ধের ফলাফল ভারতবর্ষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামোতে এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।
পলাশীর যুদ্ধ কত সালে হয়?
পলাশীর যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন, যা বৃহস্পতিবার দিন ছিল। এই যুদ্ধ কলকাতা থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার উত্তরে এবং মুর্শিদাবাদের দক্ষিণে, হুগলী নদীর তীরে পলাশী নামক স্থানে সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয় এবং ব্রিটিশ শাসনের পথ সুগম হয়।
পলাশীর যুদ্ধের কারণ ও প্রেক্ষাপট
পলাশীর যুদ্ধের কারণ ছিল বহুমাত্রিক এবং জটিল। নবাব সিরাজউদ্দৌলা তার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ইংরেজদের একের পর এক ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ এবং কোম্পানির অসদাচরণে ক্ষুব্ধ হন। এই যুদ্ধের পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ ছিল:
নবাবের সিংহাসনে বসার পর ইংরেজদের অসৌজন্যমূলক আচরণ।
নবাবের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে কলকাতায় দুর্গ নির্মাণ।
নবাবের দস্তকের অপব্যবহার ও চুক্তির শর্ত ভঙ্গ।
ইংরেজদের শুল্ক ফাঁকি দেওয়া ও জনগণের ওপর অত্যাচার।
কৃষ্ণদাসকে কাশিমবাজার কুঠিতে আশ্রয় প্রদান।
মীর জাফর, রায় দুর্লভ এবং ইয়ার লতিফের ষড়যন্ত্রমূলক ভূমিকা।
পলাশীর যুদ্ধ কখন সংঘটিত হয়?
এই ঐতিহাসিক যুদ্ধ ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন সকাল ৮টার দিকে শুরু হয়। যুদ্ধের শুরুতেই মীর মদন সাহসী আক্রমণ চালান। কিন্তু বৃষ্টিতে নবাবের গোলাবারুদ ভিজে যায়। এতে বড় ধরনের কৌশলগত বিপর্যয় ঘটে। এদিকে মীর জাফর, রায় দুর্লভ এবং ইয়ার লতিফ নিষ্ক্রিয়ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে ইংরেজদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন।
পলাশীর যুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা
মীর জাফর ছিল এই যুদ্ধের সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতক। রবার্ট ক্লাইভের সাথে গোপনে চুক্তি করে তিনি নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। যুদ্ধে যখন নবাব বাহিনী কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তখন মীর মদন ও মোহন লাল বীরত্বের সাথে লড়াই চালিয়ে যান। কিন্তু, কামানের আঘাতে মীর মদন নিহত হন এবং যুদ্ধের মোড় একদম বদলে যায়।
পলাশীর যুদ্ধের ফলাফল
পলাশীর যুদ্ধের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। এই যুদ্ধের মাধ্যমে:
মীর জাফর বাংলার নবাব হিসেবে মুকুট লাভ করেন।
ব্রিটিশরা বাংলায় প্রত্যক্ষ শাসনের সূচনা করে।
ফরাসি শক্তির পতন ঘটে এবং তারা ভারত থেকে বিতাড়িত হয়।
ইংরেজরা বাংলার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে।
রবার্ট ক্লাইভ-কে "লর্ড ক্লাইভ" উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
ভারতের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পলাশীর যুদ্ধের প্রভাব
পলাশীর যুদ্ধ উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের সূচনা করে। এর ফলে:
বাংলার রাজনৈতিক স্বাধীনতার অবসান ঘটে।
অর্থনৈতিক শোষণ শুরু হয়, যা ভারতীয় অর্থনীতিকে দুর্বল করে।
ভারতীয় সমাজে ইউরোপীয় পুঁজিবাদী সংস্কৃতির প্রভাব বৃদ্ধি পায়।
স্থানীয় ব্যবসায়ী শ্রেণী ও কৃষকদের উপর করের বোঝা বাড়ে।
পলাশীর যুদ্ধের ঐতিহাসিক গুরুত্ব
বিশ্ব ইতিহাসে পলাশীর যুদ্ধ একটি কালো অধ্যায়। এই যুদ্ধের মাধ্যমে:
ভারতের ওপর ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি স্থাপন করা হয়।
বাংলার স্বাধীনতার শেষ সূর্য অস্তমিত হয়।
ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো সম্পূর্ণরূপে পাল্টে যায়।
ভারতীয় ইতিহাসে ঔপনিবেশিক শাসনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটে।
পলাশীর যুদ্ধ সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
পলাশীর যুদ্ধ কত সালে হয়? → ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন।
পলাশীর যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল → ইংরেজদের দখল নীতি, মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা এবং নবাব বাহিনীর বিভ্রান্তি।
পলাশীর যুদ্ধের ফলাফল → বাংলার স্বাধীনতার অবসান এবং ব্রিটিশ শাসনের সূচনা।
উপসংহার
পলাশীর যুদ্ধ ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এক নৃশংস ও কলঙ্কজনক অধ্যায়। এটি কেবল একটি যুদ্ধ নয়, বরং একটি জাতির স্বাধীনতা হারানোর এক দুঃখজনক ঘটনা। এই যুদ্ধের মাধ্যমে শুরু হয় ব্রিটিশ শাসনের এক দীর্ঘ অধ্যায়, যা ভারতবর্ষের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলে। প্রতিটি বছর ২৩ জুন তারিখটি পলাশী দিবস হিসেবে স্মরণ করা হয়, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় সেই বিভীষিকাময় দিনের কথা, যখন এক ষড়যন্ত্রের জালে বাংলার স্বাধীনতার পতাকা ভেঙে পড়ে।
বাংলার ইতিহাসে পলাশীর যুদ্ধ সবসময়ই স্মরণীয় হয়ে থাকবে এবং প্রতিটি প্রজন্মের জন্য শিক্ষা ও উপলব্ধির উৎস হিসেবে কাজ করবে।