এল নিনো কি? এল নিনো উৎপত্তির কারণ ও প্রভাব
এল নিনো কি?
এল নিনো হলো পৃথিবীর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের সমুদ্রগটিতে পর্যাবৃত্ত পরিবর্তন। এটি যখন ঘটে, তখন তাহিতি এবং ডারউইন, অস্ট্রেলিয়ার বায়ুমণ্ডলে চাপের পরিবর্তন সংঘটিত হয় এবং পেরু ও ইকুয়েডরের পশ্চিম উপকূল থেকে শুরু করে সমুদ্রের পানি অস্বাভাবিকভাবে গরম বা ঠান্ডা হয়ে যায়। এল নিনো হচ্ছে এর উষ্ণ পর্যায়, আর এর শীতল পর্যায়কে বলা হয় লা নিনা। এই পর্যায়বৃত্ত পরিবর্তনের কোন নির্দিষ্ট সময় নেই, তবে সাধারণত এটি প্রতি ২ থেকে ৮ বছরের মাঝে ঘটে থাকে। এল নিনোর এই প্রক্রিয়া এবং তার প্রভাব এখনও বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিষয়।
এল নিনো শব্দের অর্থ কি?
এল নিনো একটি স্প্যানিশ শব্দ, যার মানে “বালক”। এই নামের সাথে যীশুর ছেলে সংক্রান্ত একটি সম্পর্ক রয়েছে, কারণ এল নিনো সাধারণত উত্তর আমেরিকার ক্রিসমাসের সময়ে দেখা যায়। লা নিনা স্প্যানিশ শব্দ যার অর্থ "বালিকা"। এল নিনো এবং লা নিনা উভয়ের প্রভাব সাধারণত উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার আবহাওয়ার ওপর পড়ে থাকে।
এল নিনোর প্রভাব
এল নিনো বন্যা, খরা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে সম্পর্কিত। বিশেষত, যেসব উন্নয়নশীল দেশগুলি কৃ্ষি এবং মাছ ধরার উপর নির্ভরশীল, সেসব দেশ এল নিনো দ্বারা অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এল নিনো সময়কালে, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়, যা জলাবদ্ধতা এবং বন্যার কারণ হতে পারে। অন্যদিকে, কিছু অঞ্চলে খরা দেখা দেয়, যার ফলে ফসলের ক্ষতি এবং পানির ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
এল নিনো কীভাবে ঘটে?
এল নিনো হলো সমুদ্রের উপরিভাগের জলের তাপমাত্রার পরিবর্তন। বিশেষত, পূর্ব-কেন্দ্রীয় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় শান্ত সমুদ্রের পানির গড় তাপমাত্রা যখন কমপক্ষে ০.৫° সেলসিয়াস (০.৯° ফারেনহাইট) হ্রাস বা বৃদ্ধি পায়, তখন এই প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়। যখন এটি পাঁচ মাসের কম সময় ধরে ঘটে, তখন এটিকে এল নিনো বা লা নিনা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু যদি এই ব্যতিক্রম পাঁচ মাস বা তারও বেশি সময় ধরে চলতে থাকে, তবে এটিকে প্রকৃত এল নিনো বা লা নিনা ঘটনা বলা হয়।
এল নিনোর প্রাথমিক লক্ষণসমূহ
এল নিনো শুরু হলে কিছু লক্ষণ দেখা যায়:
- ভারত মহাসাগর, ইন্দোনেশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার উপরিভাগের জলের চাপের পরিবর্তন।
- তাহিতি এবং মধ্য-পূর্ব শান্ত সমুদ্রের বায়ুচাপের হ্রাস।
- বিষুবরেখা বরাবর বাণিজ্যিক বায়ুর দুর্বল হয়ে পড়া।
- পেরুতে গরম বাতাসের উত্থান এবং উত্তর পেরুভিয়ান মরুভূমিতে বৃষ্টির সূত্রপাত।
এল নিনো সময়কালে দক্ষিণ এবং ভারতীয় সমুদ্র থেকে উষ্ণ জলের বিস্তার ঘটে। এর ফলে দক্ষিণ শান্ত সমুদ্রে অনাবৃষ্টি এবং উত্তর শান্ত সমুদ্রে বৃষ্টিপাত হয়। এ সময় উষ্ণ অপুষ্টিকর বিষুবীয় জলস্রোত ঠান্ডা পুষ্টিসমৃদ্ধ বিষুবীয় হাবল্ট জলস্রোতের সাথে অদলবদল ঘটে, যা সামুদ্রিক জীবন ও মাছ ধরার ক্ষেত্রে বড় প্রভাব ফেলে।
এল নিনোর প্রাথমিক ধাপ এবং বৈশিষ্ট্য
এল নিনো ঘটনার কারণ এবং এর প্রক্রিয়া এখনও গবেষণার অধীনে রয়েছে। তবে এটি সাধারণত বাণিজ্যিক বায়ু এবং ওয়াকার সঞ্চালন প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে কেলভিন তরঙ্গ মিলিত হয়ে উষ্ণ জলের সৃষ্টি করে, যা বৈশ্বিক আবহাওয়ার পরিবর্তনেও ভূমিকা রাখে।
দক্ষিণাঞ্চলীয় পর্যায়বৃত্ত পরিবর্তন
দক্ষিণাঞ্চলীয় পর্যায়বৃত্ত পরিবর্তন হলো এল নিনোর বায়ুমণ্ডলীয় অবস্থার বিপরীত অবস্থা। এটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় উত্তর এবং দক্ষিণ শান্ত সমুদ্রের মধ্যে একটি পর্যায়বৃত্ত চক্র। এই চক্রের শক্তিমাত্রাকে পরিমাপ করা হয় সাউদার্ন অসিলেশন ইন্ডেক্স দ্বারা। এই সূচক তাহিতি এবং ডারউইন, অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার বায়ুচাপের পার্থক্য নির্ণয় করে। এল নিনোর ঘটনা প্রবাহ সাউদার্ন অসিলেশন ইন্ডেক্স এর ঋণাত্মক মান প্রকাশ করে, যা ডারউইন থেকে তাহিতিতে বায়ুচাপ কমার নির্দেশ করে।
এল নিনোর প্রভাব: গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সাইক্লোন
গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সাইক্লোন এল নিনো সময়কালে অনেকটা বৃদ্ধি পায়। এল নিনোর প্রভাবের কারণে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আটলান্টিক সাগর উল্লম্বভাবে আনত শক্তিশালী বাতাসের সৃষ্টি হয়, যা সমুদ্রকে উত্তাল করে তোলে। এল নিনোর ফলে এসব সাইক্লোনের সৃষ্টি হয় এবং এর প্রভাব বিশেষত জাপান এবং কোরিয়া অঞ্চলে পড়ে।
এল নিনোর সাম্প্রতিক ঘটনা এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি
এল নিনো এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি উভয়ই পরিবেশে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে সক্ষম। কিছু বিজ্ঞানীর মতে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে এল নিনো আরও শক্তিশালী হতে পারে। আবার কিছু গবেষণায় বলা হয়েছে, উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে এল নিনো দুর্বল হতে পারে।
এল নিনো এবং লা নিনা: বৈশ্বিক প্রভাব
এল নিনো এবং লা নিনা উভয়ের প্রভাব বৈশ্বিক পর্যায়ে বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে। এটি বিভিন্ন অঞ্চলে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটায় এবং এর ফলে বন্যা, খরা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে। বিশেষত, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়।
এল নিনো: ঐতিহাসিক তথ্য
অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত বেশ কিছু এল নিনো ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৪০-১৯৪১, ১৯৫৭-১৯৫৮ এবং ১৯৭২-১৯৭৩ সালের এল নিনোকে শক্তিশালী হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে এই ধরনের ঘটনা আরও বেশি শক্তিশালী হতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন।
এল নিনো নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন
এল নিনো এবং লা নিনা ঘটনা এখনও বিজ্ঞানীদের কাছে রহস্যময়। এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে আরও গভীর গবেষণা প্রয়োজন যাতে এর কারণ এবং প্রভাব সম্পর্কে আরও সঠিক ধারণা পাওয়া যায়। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে ভবিষ্যতে এল নিনোর প্রভাব কীভাবে পরিবর্তিত হতে পারে, তা নিয়ে আরও বিস্তৃত গবেষণা প্রয়োজন।
উপসংহার
এল নিনো বৈশ্বিক আবহাওয়া এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এটি শুধুমাত্র সমুদ্রের তাপমাত্রা পরিবর্তন নয়, বরং এর প্রভাব বৈশ্বিক পর্যায়ে অনুভূত হয়। এল নিনো এবং লা নিনা উভয়ই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের আবহাওয়ার উপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলে, যা বন্যা, খরা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ হতে পারে। বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে আরও সঠিক ধারণা পাওয়া গেলে, এর প্রভাব থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় খুঁজে পাওয়া সম্ভব হতে পারে।
এল নিনোর মানে কি?
“এল নিনো” হচ্ছে একটি স্প্যানিশ শব্দ, যার মানে “বালক” এবং নির্দেশ করা হয় “যীশুর ছেলে” বলে, কারণ এই পর্যাবৃত্ত উষ্ণ সামুদ্রিক জলস্রোতের পরিবর্তন সাধারণত উত্তর আমেরিকার ক্রিসমাসের সময়ই দেখা যায়। আর “লা নিনা” স্প্যানিশের মানে হচ্ছে little “বালিকা”। এল নিনো বন্যা, খরা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
এল নিনো শব্দের অর্থ কি?
স্প্যানিশ ভাষায় এল নিনো মানে ছোট ছেলে । দক্ষিণ আমেরিকার জেলেরা প্রথম 1600-এর দশকে প্রশান্ত মহাসাগরে অস্বাভাবিকভাবে উষ্ণ জলের সময়কাল লক্ষ্য করেছিলেন। তারা যে পুরো নামটি ব্যবহার করেছিল তা ছিল এল নিনো দে নাভিদাদ, কারণ এল নিনো সাধারণত ডিসেম্বরের কাছাকাছি থাকে।
এল নিনো সৃষ্টির কারণ কি?
এল নিনোর অবস্থা তখন দেখা দেয় যখন নিরক্ষীয় প্রশান্ত মহাসাগরে ভূপৃষ্ঠের পানি গড়ের চেয়ে বেশি উষ্ণ হয় এবং পূর্বের বাতাস স্বাভাবিকের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে ।
এল নিনো ও লা নিনার মধ্যে পার্থক্য কি?
এল নিনো বলতে বোঝায় উপরের গড় সমুদ্র-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা যা পর্যায়ক্রমে পূর্ব-মধ্য নিরক্ষীয় প্রশান্ত মহাসাগর জুড়ে বিকাশ লাভ করে। এটি ENSO চক্রের উষ্ণ পর্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করে। লা নিনা পূর্ব-মধ্য নিরক্ষীয় প্রশান্ত মহাসাগর জুড়ে সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রার পর্যায়ক্রমিক শীতলতাকে বোঝায়।
ENSO বলতে কী বোঝায়?
ENSO হল একটি জলবায়ু ঘটনা যা মধ্য ও পূর্ব গ্রীষ্মমন্ডলীয় প্রশান্ত মহাসাগরের জলের তাপমাত্রার পরিবর্তনের সাথে ওভারল্যাং বায়ুমন্ডলে ওঠানামা করে।